- August 13th, 2022
নিখিল ভুবনটা একেবারে অন্যরকম
শুভেন্দু দেবনাথ
‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে॥
সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,
আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে।’
জীবন বড় অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত কলকাতার মানুষও। কে যে কখন কোন বাঁকে এনে দাঁড় করাবে কে জানে।
প্রতিনিয়ত কাজ করতে গিয়ে শিক্ষিত বাঙালির কাছে চাকর-বাকরের ব্যবহার পেয়েছি, তাদের ভাবখানা এমন যেন তাঁদের সেবা করে আসলে আমরা নিজেরাই ধন্য হচ্ছি। যেন সব দায় আমাদের। কেউ কেউ তো হাসপাতালে কথাবার্তা বলে বেড জোগাড় করে দেওয়ার পর জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন তো? তাহলে অ্যাম্বুল্যান্স ছেড়ে দেব।’ কিংবা ‘শুনুন এই গরমে একটু অক্সিজেন সিলিন্ডারটা বাড়িতে দিয়ে যাবেন? এই রোদে আমি বেরতে পারব না।’ এক বিখ্যাত মানুষের আত্মীয় তো ফোনে বলেই ফেললেন, ‘শুনুন আমাদের ঘণ্টায় ঘণ্টায় সার্ভিস দরকার। আমার ছেলে একটু চিপস চকোলেট আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে ভালোবাসে, সেই সঙ্গে আমাদের চায়ের দুধ চিনি যদি একটু যোগান দিতে পারেন।’ মুখের উপর বলতে বাধ্য হয়েছিলাম আমরা আপনার চাকর নই। তার বাড়ির নীচেই দোকান। ব্যালকনি থেকে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিলেই সব হাতের মুঠোয়। তবু…
রোজ রোজ যখন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত শ্রেণির উন্নাসিকতা আর অমানবিকতা দেখছি, দেখছি তাদের আসল চেহারা তখন বারবার আমাকে অবাক করেছে সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো। রাস্তায় বেরিয়ে যাদের ‘তুই’ ‘তুমি’ ব্যতীত আপনি সম্বোধন করতে ইগোতে লাগে। আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে বারবার মনে পড়ছে আমার পাড়ার রিকশওয়ালা নিখিলদার কথা।
গত ১৮ মে ঘুম ভাঙে দুঃসংবাদ দিয়ে। শীর্ষদা মানে শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই। মানুষটার সঙ্গে আমার খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল না তবে ভালো সম্পর্ক ছিল। বইমেলায় দেখা হলে বলেছিলেন, ‘আবার চম্বল’ পড়ে ভীষণ ভালো লেগেছে, জলদি এর দ্বিতীয় পার্ট পড়তে চাই। চম্বলের আরও গভীরে ঢুকে তুলে আনো রহস্য।
ওই সপ্তাহ ধরেই আমাদের অক্সিজেনের খোঁজ চলছিল। দক্ষিণ কলকাতায় তখন অনেক কষ্টে অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় হলেও উত্তর কলকাতা জুড়ে তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুষ্প্রাপ্য। অনেক কষ্টে আমাদের এক ভলান্টিয়ার জুনিয়র ডাক্তার মহেন্দ্র বণিক খড়দা থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সস্তায় আনতে পেরেছিল। বিভিন্ন এলাকার ভলান্টিয়াররা মিলে মোট ১৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল আমার সিলিন্ডারটি আমি কোন্নগরে মহেন্দ্রর কাছ থেকে নিয়ে আসব। কিন্তু যেতে পারিনি কাজে আটকে পড়ায়। মহেন্দ্রকে সে কথা জানাতেই নিজের পারিবারিক বিপর্যয়কে দূরে সরিয়ে রেখে বাইকে করে দমদমে পৌঁছে দিয়েছিল সিলিন্ডারটি। আমাকে সিলিন্ডারটি পৌঁছে দিয়ে মাহী যাবে মেমারিতে, নিজের আত্মীয়র সৎকারে। মেমারিতে? কী অদ্ভুত না? যেখানে মানুষ স্বার্থের জন্য এক পা-ও নড়তে রাজি নয়, সেখানে মহেন্দ্রর মতো ছেলেরা বাড়ির শোক ভুলে ছুটে আসছে কিছু মানুষ শ্বাস নেবে বলে।
“এ লড়াই শেষের লড়াই
এ লড়াই বাঁচা মরার
এ লড়াই তোমার আমার
এ লড়াই সর্বহারার।।
এ লড়াই জিততে হবে
কঠিন বুকে শপথ নিলাম
এ লড়াই জিতবো বলে
কত না প্রাণ বিলিয়ে দিলাম”।।
ধুলো উড়িয়ে বাইক নিয়ে চলে যায় মাহী। দীর্ঘদিন ধরে পাড়ায় রিকশ চালানো নিখিলদাকে ডাক দিই। সেই গোরাবাজার মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালের সামনে যেতে হবে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি রিফিল করার জন্য। আমার ফ্ল্যাটটি আড়াই তলায়। মেজেনাইন ফ্লোর। সেখান থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি একার হাতে নামিয়ে রিকশয় রাখে নিখিলদা। প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে নিখিলদা গল্প জুড়ে দেয়। গোরা বাজারে হাসপাতালের ঠিক পাশেই রেণুকা এন্টারপ্রাইজ। সেখানে পৌঁছে রিফিলিংয়ের দরদাম করি। দোকানের মালিক ভদ্রলোক জানতে চান আমরা কি রেড ভলান্টিয়ার সংগঠন নাকি আমাদের কোনও এনজিও আছে। তাঁকে জানাই, আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলেই নেমে পড়েছি কাজে। তিনিও জানান যে তিনি আর তাঁর ছেলেও সময় পাচ্ছেন না। সব সময় ফোন বাজছে। তাঁর কাছে নানা জায়গা থেকে ফোন আসছে। এই তো আমি আসার আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে ফোন এসেছিল এক বাঙালি পরিবারের, যদি দমদমে তাঁদের বাড়িতে বয়স্ক লোককে একটা সিলিন্ডার দেওয়া যায়।
ভদ্রলোক জানান তিনি তবু ফোনে কাজ করছেন, কিন্তু তাঁর ছেলে নাওয়া নেই খাওয়া নেই দৌড়চ্ছে ভলান্টিয়ারের কাজ করতে। অনায়াসেই দোকানে বসে তিনি মুনাফা করতে পারতেন। কিন্তু ছেলের না পসন্দ। আমাকে বলেন, তোমাদের কাছ থেকে আর কি লাভ রাখব, অন্যদের কাছ থেকে তো অনেক বেশি নিচ্ছি তুমি বরং পার রিফিলিং ৫০০ করেই দিও। আর তোমাদের যখন দরকার এসো, আমার দরজা তোমাদের জন্য খোলা রইল। ফিরতি পথে অনেকটা রাস্তা নিখিলদা চুপ থাকে। এত চুপচাপ কখনই থাকে না নিখিলদা। প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে রিকশ চালাতে চালাতে গল্প জুড়ে দেয়। কী ভাবছে কে জানে। ঠিক ঝিলপাড়ের কাছে আসতেই হঠাৎ করে নিখিলদা প্রশ্নবাণে আমাকে বিদ্ধ করতে থাকে। কেন আমি নিজের কাজকম্ম ফেলে এ ভাবে দৌড়চ্ছি, এতে আমার কি লাভ হচ্ছে। অফিসের কাজ করছি কখন সারাদিন এসব করতে গিয়ে।
অফিসের ক্ষতি হচ্ছে কি না। কোনও জবাব দিই না। হাসি। নিখিলদাকে কী করে বলব অফিসের কাজ সে ভাবে হচ্ছে কই? কি করে বলব, আমার এক অমানবিক সিনিয়রের কথা? একটা হাসি দিয়ে চুপ করে থাকি। বাড়ির সামনে পৌঁছে নিখিলদাই ঘাড়ে করে সিলিন্ডার ঘরে পৌঁছে দেয়। এমনিতে মতিঝিল থেকে গোরা বাজার ৫০টাকা ভাড়া। দুই পিঠ মিলিয়ে ১০০ টাকা। কিন্তু এই করোনায় ভাড়া বেড়েছে, কম করে ৬০-৭০ টাকা তো একপিঠের ভাড়া। নিখিলদাকে জিজ্ঞাসা করি কত টাকা দেব? আমাকে অবাক করে নিখিলদা বলে ওঠে ২০ টাকা দাও। মনে হল ভুল শুনছি। আবারও জিজ্ঞাসা করি কত? নিখিলদা বলে ২০ টাকা। অবাক হয়ে তাকাতেই কালো মুশকো চেহারার নিখিলদা বলে দাদা গত বিশ-বাইশ দিন ধরে দেখছি তোমাকে। পাড়ার বাকিরা যখন আড্ডা মারছে, নিজের নিজের দিকটা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তুমি দৌড়ে বেড়াচ্ছ সকলের জন্য। আমার কী বিবেক বলে কিছু নেই? আমাকে ২০ টাকাই দাও, আর যখনই যেখানে দরকার পড়বে আমাকে ডাকবে। ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখো। আমি ওই ২০ টাকাই নেব। বলেই তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় সারা বছর গুনে গুনে ভাড়া নেওয়া নিখিলদা।
গত কয়েক দিন ধরে যেখানে শিক্ষিত সম্পন্ন মানুষের নগ্ন চেহারাগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠছিল, সেখানে বারবার এই নিখিলদার মতো মানুষগুলো আমাকে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেন বারবার ডেকে ডেকে বলছে মিথ্যেই তোমরা শিক্ষার বড়াই করো। যতই আমি আর আমার দলের ছেলেরা তাঁদের মুখোমুখি হচ্ছি ততই যেন রোজ রোজ আমাদের বুকের হাপরে অক্সিজেন রিফিল করে দিচ্ছে নিখিলদারা। আর সেই অক্সিজেনে ভর করেই আমরা বিরাটি, হেদুয়া, পাইকপাড়া, শ্যামবাজার সহ গোটা উত্তর কলকাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। লোকে আমাদের ধন্য ধন্য করছে, কিন্তু তারা জানছে না আড়ালে তাদেরই পাড়ার নিখিলদারা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। নিখিলদাদের ফেসবুক নেই, নম্বর ভাইরাল হয় না, যোগাযোগ কম। তাই তারা আড়ালেই থেকে যান আর প্রশংসা পাই আমরা। আসলে নিখিলদারাই আলো দেয় আমাদের, আর আমরা আলোকিত হই।
“এ লড়াই সেই সে লড়াই
সকল লড়াই ঘুচিয়ে দেবার
এ লড়াই বহু দিনের বাকির হিসেব চুকিয়ে দেবার।
এ লড়াই আঁধার চিরে
আলোর তোরণ পরশ করার
এ লড়াই তোমার আমার
এ লড়াই সর্বহারার”।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

