- August 13th, 2022
স্বদেশিআনায় নেশাযোগের সূচনা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জীবনে যে কাজটাই করি না কেন, একেবারে সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে তারপর ধীরে ধীরে এগিয়েছি। হয়তো কোনও সিঁড়িতেই আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, তবে প্রতিটিতে আমার পা পড়েছে। এই যেমন সাংবাদিকতা নামক যে পেশাটিতে আমার কর্মজীবনের পুরোটাই কেটে গেল, সেখানেও আমার প্রবেশ শিক্ষানবীশ হয়ে। তারপর একে একে সাব এডিটর, সিনিয়র সাব এডিটর, চিফ সাব এডিটর, প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট, স্পেশাল করেসপনডেন্ট, চিফ অফ ব্যুরো, বার্তা সম্পাদক, কার্যনির্বাহী সম্পাদক, সবশেষে সম্পাদক। নিচু থেকে ধাপে ধাপে উপরে ওঠার অনেক সুবিধে আছে, তবে আজ থাক সে প্রসঙ্গ।
পানধ্যানের ক্ষেত্রেও আমার রেকর্ড প্রায় একই রকম। কালী মার্কা দিয়ে আচমন, তারপর কলেজে গিয়ে কলাবাগানের চোলাই, রোজগার শুরু হলে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পদতলে নিজেকে সমর্পণ, সবশেষে কেবলই বিলিতি। স্বাস্থ্যের কারণে আমি সুরা-রসে বঞ্চিত তাও অনেক কাল হয়ে গেল। তাই বলে স্বর্ণাভ অতীতটাই বা ভুলি কী করে? ভুলবই বা কেন? জীবনে যে মাতালই হল না, যমরাজের সামনে দাঁড়িয়ে সে এমন স্খলন আর কাপুরুষতার ব্যাখ্যা দেবে কী করে? আর কিছু না হোক তাকে মাথা হেঁট করেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
মাতৃগর্ভ থেকে বেরোনো ইস্তক আমি বখাটে ছেলে, আগেও লিখেছি, আবার লিখছি। ক্লাস ফোর-ফাইভে যখন, সিগারেটে প্রথম টান দিয়েছি। প্রথম বিয়ার চেখে দেখেছি ক্লাস নাইনে। আমরা তিন বন্ধু মিলে বালিগঞ্জ ওয়াইন স্টোর্স থেকে একটা কল্যাণী ব্ল্যাক লেবেল বিয়ারের বোতল কিনে নির্জনতার সন্ধানে চলে গেলাম বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মিলিটারি ক্যাম্পের কাছে। তখন সেটা ফাঁকা জমি ছিল, পরে সেখানেই সপ্তপর্ণী বহুতল আবাসন হয়েছে। দাঁত দিয়ে ছিপি খুলে প্রথম ঢোঁক গলায় যেতেই মনে হল যেন চিরতার জল খাচ্ছি, এমন বিদ্ঘুটে তেতো। টাকা জলে গেল, নেশা হওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই, তদুপরি এমন বিস্বাদ। বড্ড প্রতারিত মনে হয়েছিল নিজেকে সে দিন।
আমরা সাব্যস্ত করলাম, এই সব বিয়ার-ফিয়ার আমাদের মতো গরিব-গুর্বের জন্য নয়। এতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। না সস্তা না পুষ্টিকর। তাহলে? তাহলে আবার কী! আমরা মহাজ্ঞানী, মহাজনদের পদানুসরণ করে এবার থেকে পুরোদস্তুর ‘স্বদেশি’ হব। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, দীন দুখিনি মা যে মোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।’
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, মাত্রই কয়েক মাস হল কলকাতায় এসেছি। এসেই রতনে রতন চেনার মতো পাড়ায় এক্কেবারে মনের মতো কয়েকজন বন্ধুও জোগাড় করে ফেলেছি। বিকেলগুলো কাটে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। হাতে হাতে ঘুরতে থাকে সিগারেটের কাউন্টার। সেই আড্ডাতেই সর্বান্তঃকরণে প্রস্তাব পাশ হল এবার পুজোয় স্বদেশি।
কলকাতায় আসার পরে বাবার চাপিয়ে দেওয়া সামরিক শৃঙ্খলা একটু একটু করে যেন শিথিল হতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরার দীর্ঘদিনের ফতোয়া কখন অলক্ষ্যে উঠে গেল, এমনকী পুজোর রাতগুলো বাইরে কাটানোর অনুমতি মা মারফত পকেটস্থ করতেও বেশি বেগ পেতে হল না। মন-ময়ূর পেখম তুলে নাচতে শুরু করল। গুনগুন করে গাইতে শুরু করলাম, ‘এই তো আমি চাই, চাই রে......।’
আমাদের পক্ষে ‘স্বদেশি’ হওয়াটা ছিল যতটা সহজ, ততটাই স্বাভাবিক। আমাদের পাড়ার ঠিক উল্টোদিকে কয়েকশো পা দূরত্বে, হাজরা রোড লাগোয়া একটা ছায়াছায়া গলির শেষ প্রান্তে ছিল গড়চার দিশি মদের ঠেক। বারদুয়ারির বা খালাসিটোলার মতো কৌলীন্য তার ছিল না, শক্তি-সুনীল-সন্দীপন-কমলকুমারের পদস্পর্শে সে কদাচ ধন্যও হয়নি, গড়চা ছিল ষোলো আনা ‘সাবঅল্টার্ন’ ঠেক। মুটে, মজুর, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা ইত্যাদি মেহনতি জনতার দরবার। আমাদের পাড়ার পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র গোপালদা এই ঠেকে যেত প্রতি দুপুরে একেবারে নিয়ম করে। কোনও একটা নামী সওদাগরি অফিসে চাকরি করত, হঠাৎ সেটি খোয়ানোর পরে জীবনের সব গ্লানি, সব কষ্ট সে ভুলতে চাইত ওই গলিপথে। সজনে ডাঁটার মতো লিকলিকে চেহারা, পরনে লুঙি, বোতাম খোলা বুশ শার্ট অথবা শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। ঠেক থেকে গোপালদা ফিরত রীতিমতো টলমল পায়ে দুলতে দুলতে, বিড়বিড় করে নিজের মনে কী সব যেন বলত। কখনও বাংলায় কখনও ইংরেজিতে। মত্ত অবস্থায় একবার আমায় কাছে ডেকে নিয়ে গোপালদা বলেছিল, ‘শোন, একটা কথা বলছি। সারাটা জীবন সেটা মনে রাখবি।’
কী কথা?
‘মাতাল মাতাল হতে পারে, মাতলামি করতে পারে, চেঁচামেচি, মারপিট করতে পারে। সব লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। কিন্তু একটা কাজ সে কোনও দিন করবে না। শঠতা। মনে রাখবি মাতাল হয় না শঠ।’ পরে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি গোপালদা সেদিন খুব ভুল কথা বলেনি।
বাংলা মদ তখন তিনটি সাইজের বোতলে পাওয়া যেত — সর্বকনিষ্ঠটির নাম ‘ফাইল’, মূল্য সাড়ে তিন টাকা। মেজজনের নাম ‘পাঁইট’, মূল্য সাড়ে পাঁচ টাকা। আর বড়দার নাম ‘বোতল’, মূল্য সাড়ে আট টাকা। আমরা চার বন্ধু মিলে স্থির করলাম, অষ্টমীর রাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আমরা নিজেদের ঠেকে বসে স্বদেশ বন্দনা করব। তারপর বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাঞ্জাবি ধাবায় গিয়ে গরম গরম রুটি আর এগ-তড়কা খাব। আহা, সে কী অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি! ভাবলেই সাহারায় শিহরণ। কত লোকে পুজোয় কত কিছু করে, আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল এইটুকুতেই সন্তুষ্ট! সস্তার পান, সস্তার ভোজন।
বোতল তো এল, কিন্তু ঢালব কোথায়? নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন। মগজাস্ত্রে শান দিয়ে আমি এক দৌড়ে কাছের চায়ের দোকান থেকে চারটি সবচেয়ে বড় সাইজের মাটির ভাঁড় নিয়ে এলাম। একটি চুমুক গলায় ঢালতেই আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বিয়ার ছিল চিরতার জল, এ তো দেখছি গলানো শিসা, মনে হচ্ছে কন্ঠনালীটাই না পুড়ে ছারখার হয়ে যায়! সঙ্গে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ, নাকের কাছে ধরলে মরা মানুষও লাফ দিয়ে উঠে পড়তে পারে। যে পানের দোকানের পিছনের নিঃঝুম অন্ধকারে ইটের উপর আমরা মেহফিল বসিয়েছিলাম, তার মালিক হঠাৎ দেবদূতের মতো আমাদের সামনে উদয় হলেন। তাঁর দু’হাতে দুটো লিমকার বোতল। ‘আরে বাবু বাংলা মদ কেউ নিট খায়? এই লিমকা মিশিয়ে খান দেখবেন ভালো লাগবে।’
ভালো বললে কিছুই বলা হয় না। নেহাতই ‘আন্ডারস্টেটমেন্ট’। আগের মুহূর্তে যে তরলকে মনে হচ্ছিল গরল, লিমকার ছোঁয়ায় সেটাই হয়ে গেল অমৃত-সমান। বোতল সাফা হয়ে গেল চোখের নিমেষে। বেশ একটা দোলনমায়ায় ডুবে যাচ্ছে মন, মনে হচ্ছে চাইলে এখন আমিও সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হতে পারি। পারি ঠিক উল্টোদিকে সুচিত্রা সেনের দরজায় কড়া নাড়তে। ১৯৭১-এর মহাষ্টমীর সন্ধ্যায়, সন্ধিপুজোর অব্যবহিত আগে, বিশুদ্ধ স্বদেশি কায়দায় নেশা-যোগ শুরু হল আমার জীবনে। থেকেছিল অন্তত সিকি শতক।
অনেক কাল পরে দিশির আর এক প্রকার মাহাত্ম্যগাথা শুনেছিলাম এক সুরসিক রামভক্তের কথায়। তখন আমি ঘন ঘন দিল্লি থেকে অযোধ্যায় যাই, রাম জন্মভূমি আন্দোলন কভার করতে। তখন অযোধ্যায় পাতে দেওয়ার মতো হোটেল ছিল একটাই- শান এ আওধ। পরিযায়ী রিপোর্টাররা সেই হোটেলেই উঠত, সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘরে শুরু হত মজলিস।
এমনই একটি মজলিসে একজন হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আপনারা কি জানেন, কোন দেবতার সঙ্গে কোন মদের সম্পর্ক?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলতে শুরু করলেন—
ব্র্যান্ডি পে ব্রহ্মা বসে/ রাম পে বসে রাম/ হুইস্কি পে বিষ্ণু বসে/ দেশি পে হনুমান।
ঘরের ভিড় থেকে সমস্বরে কোরাস উঠল, ‘বোল বোল সিয়াবর রামচন্দ্র কী জয়/ পবনপুত হনুমানকী জয়!’


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

