- August 13th, 2022
বঙ্গসমাজের শেষ আলোকবর্তিকা
বঙ্গসমাজের শেষ আলোকবর্তিকা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জীবনে দুর্যোগ কম দেখিনি, প্রাপ্যের চেয়ে বেশিই দেখেছি বোধহয়। কিন্তু নিজেকে এতটা অসহায় আর কখনও মনে হয়েছে কি? মনে করতে পারছি না।
দুপুর নাগাদ শুনলাম শঙ্খ ঘোষের চলে যাওয়ার খবর। বয়স হয়েছিল ঊননব্বই, শারীরিকভাবে বেহাল হয়ে পড়েছিলেন, সত্যি। তাই বলে করোনা কবির প্রাণ নেবে, মন থেকে এ কথা মেনে নেওয়া যায় কি? ঠিক যেমন কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না কোভিড-প্রোটোকল মানা তাঁর অন্তিম যাত্রার দৃশ্য, আপাদমস্তক সাদা সেলোফিনে মোড়া, মানুষ তো নন যেন মমি। ভাইরাসের এমন স্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত।
শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার আলগা ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, এইটুকুই। আমি কোনোদিন তাঁর বাড়ির বৈঠকখানার আড্ডায় উপস্থিত হইনি, আমার মতো বেহদ্দ অ-কবির তেমন অবকাশও হয়নি। যাঁরা নিয়মিত যেতেন তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে, তাঁদের মুখে আড্ডা নিয়ে নানা কথা শুনেছি। শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হত হঠাৎ-হঠাৎ, কোনো অনুষ্ঠানে, আলোচনা অথবা শোকসভায়। প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বি-শত বর্ষপূর্তির দিনে আমরা প্রাক্তনীরা স্বামী বিবেকানন্দর বাড়ির সামনে থেকে কলেজ-গেট পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য পদযাত্রা করেছিলাম, শঙ্খবাবু প্রথম সারির মধ্যমণি হয়ে পুরোটা রাস্তা হেঁটেছিলেন। সেটাই বোধহয় আমার শেষ শঙ্খ-দর্শন।
তবে আমি তাঁর দুই আত্মজাকে দীর্ঘকাল যাবৎ চিনি। বড়ো মেয়ে আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র, প্রেসিডেন্সি কলেজে একই সময় পড়েছি। আর ছোটো-জনকে গবেষণার জগৎ থেকে ফুসলিয়ে বাংলা সাংবাদিকতায় নিয়ে এসেছিলাম আমিই। আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুগত বসুর কাছে বস্টনে সে পি এইচ ডি করছিল, সেখানেই তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, পরে সাধাসাধি। কলকাতায় ফিরে অন্য কোথাও না গিয়ে সে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আসে, এখন সুপরিচিত লেখক-সম্পাদক। শঙ্খবাবুর স্ত্রী প্রতিমা দেবী বিদ্যাসাগর কলেজে আমার দিদির অগ্রজ সহকর্মী ছিলেন, ওঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও খুবই মধুর। আমি, তার মানে, কবির বৈঠকখানায় যেতে না পারলেও, কাছাকাছি ঘুরঘুর করেছি বলতে পারেন।
তবু কেন জানি না শঙ্খবাবুর এমন অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত মৃত্যু আমাকে বিশেষভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। তার কারণ এই নয় যে আমি তাঁর পদ্য ও গদ্যের মুগ্ধ, নিবেদিত ভক্ত, তাঁর শব্দহীন শব্দোচ্চারণের মগ্ন পাঠক। এই সেদিনই ‘গুরুচণ্ডালিতে’ শঙ্খবাবুর একটি লেখা পড়লাম তাঁর দীর্ঘদিনের কবি-বন্ধু সদ্য-প্রয়াত অলোক রঞ্জন দশগুপ্তকে নিয়ে, সম্ভবত তাঁর শেষ প্রকাশিত গদ্য-রচনা। পড়ে এমনই মোহিত হলাম যে বিভাগীয় সম্পাদক, শঙ্খবাবু এবং আমার দু’জনেরই অতি আপনজন, নীলাঞ্জন হাজরাকে ফোন করে অভিনন্দন জানালাম। নীলাঞ্জন জানাল, তার অনুরোধ রাখতে কত কষ্ট করে শঙ্খবাবু লেখাটি লিখেছেন। শঙ্খ ঘোষ অনাবশ্যক কথা বলতে একেবারেই পছন্দ করতেন না, সভা-সমিতিতে হাজির থাকলেও নির্বাক শ্রোতার ভূমিকাটি থেকে তাঁকে নড়ানো যেত না, নবনীতা দেব সেন রসিকতা করে তাঁকে বলতেন ‘আমাদের বোবা কবি’। কিন্তু যাঁদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন, তাঁদের লেখার অনুরোধ চট করে তিনি ফেলতে পারতেন না, এমন স্নেহাস্পদের সংখ্যাটাও অগুন্তি।
আমার বিপন্ন বোধ করার একমাত্র কারণ বাঙালি জীবনের এই ঘোর অমানিশায় একমাত্র আলোকবর্তিকাটির নিভে যাওয়া। এই বেদনাতুর অনুভূতিটি কতটা অস্বস্তিকর তার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন, যে কোনো সংবেদনশীল বঙ্গসন্তানই তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন। বিবেক এবং মেরুদণ্ড দু’টোই যে সমাজে দ্রুত অপসৃয়মান, বাঁচার পাথেয় হয় সুবিধাবাদ নতুবা সুচিন্তিত নীরবতা, শঙ্খ ঘোষ সেখানে যখনই উচিত মনে করেছেন তখনই হয় কলম ধরেছেন নয়তো সোজা নেমে এসেছেন রাজপথে। ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে তিনি রাজনীতির রং দেখেননি, নন্দীগ্রাম আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নকে একইভাবে বিঁধেছেন। শঙ্খবাবু আছেন, শরীর ভেঙে গেলেও আছেন, এইটুকুই ছিল সহ-নাগরিকের স্বস্তি পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। করোনা কেবল এক যশস্বী কবি-কথাকারকে নিয়ে গেল না, একটা পথভ্রষ্ট সমাজকে বড়ো অসময়ে অভিভাবকহীন করে গেল।

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

