- August 16th, 2022
রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে কী হতো?
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির ‘লাইট হাউস’
লায়লা আফরোজ
আম্মা স্নান সেরে এলোচুলে ঘরের চৌকাঠে বসে কাঠির ডগায় কার্পাস তুলো পেঁচিয়ে বুরুশ বানিয়ে আলতার শিশিতে চুবিয়ে চুবিয়ে পায়ে গাঢ় লাল আলতা পরতেন। আমি তখন আলতার শিশিটা শক্ত হাতে ধরে থাকতাম। সবশেষে তিনি পায়ের ওপর একটা লাল বৃত্ত আঁকতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দেখতাম। পূর্ণিমা রাতে উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে তিনি মেহেদি লাগাতেন। সকালে উঠে হাতে হাত ঘসে শুকনো বিবর্ণ মেহেদির গুঁড়ো মাটিতে ফেলতেন। আমি তাঁর টুকটুকে লাল হাতে নাক ডুবিয়ে অদ্ভুত বুনো গন্ধ নিতাম।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে জন্ম নেওয়া এই নারী কখনও স্কুলে যাননি। রেওয়াজ মাফিক বাড়িতেই বাংলা এবং আরবি কেতাব পাঠ শিখেছেন। দুপুরে সংসার সামলে আবলুশ কাঠের পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে তিনি ‘কপালকুণ্ডলা’ পড়তেন। একদিন তিনি ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ পড়ছিলেন। সেই প্রথম আমি ওই বইয়ের গায়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটি বানান করে পড়ি। প্রশ্ন হলো-‘আসমানি কিতাব’ কিংবা ‘জঙ্গনামা’ না পড়ে তিনি কেন ওইসব বই পড়তেন? আর কেই বা তাঁকে ওই সব বইয়ের জোগান দিতেন? নির্ঘাৎ, আমার আব্বা যিনি ‘পোর্ট ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া’র অধীন কলকাতা বন্দরে (৩,ফেয়ারলি প্লেস) চাকরি করতেন। ছুটির দিনে ইডেন গার্ডেনে মহমেডান-ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল খেলা না দেখলে যাঁর চলতই না! প্রকৃত অর্থেই তিনি ‘ইয়ং বেঙ্গল’ ছিলেন, যিনি স্ত্রীর জন্য আলতার শিশি কেনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের বই কিনতেও ভুলতেন না!
সমাজতন্ত্রে দীক্ষাপ্রাপ্ত আমার বড় ভাই যিনি গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের নায়ক পাভেল দ্বারা প্রাণিত হয়ে বলতেন- ‘বিপ্লব আর বিবাহ পরস্পর বিরোধী’ তিনিও পরম্পরা বজায় রেখে বইয়ের পোকা ছিলেন। স্যার ওয়াল্টার স্কট-এর ‘আইভানহো’র পাশাপাশি তাঁর আদর্শিক ‘আইকন’ হয়ে ওঠেন ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এর নিঃসঙ্গ প্রলেতারিয়েত মহাবীর কর্ণ। ‘জয়লোভে, যশোলোভে, রাজ্যলোভে অয়ি/ বীরের সদগতি হতে যেন ভ্রষ্ট নাহি হই’ উচ্চারণ করতে করতে তাঁর চোখ আর্দ্র হয়ে উঠত। শৈশবে তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্রকাব্য পাঠ শুনে ‘নির্মোহ’ হওয়ার শিক্ষা নিয়েছি। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও আদর্শ বিসর্জন না-দিয়ে কী ভাবে প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে হয় সেই শিক্ষা আমাকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘খান্তবুড়ির দিদি শাশুড়ির পাঁচবোন থাকে কালনায়’ পড়ে ছোটবেলায় কালনা কোথায় তা দেখতে মানচিত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি! আমার এই অনুসন্ধিৎসু মনটা তৈরি করে দিয়েছেন পরোক্ষে রবীন্দ্রনাথ! বড়ো হয়ে-‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠলো রাঙা হয়ে’ আওড়াতে গিয়ে বুঝেছি চেতনাই হচ্ছে আসল যা একজন ব্যক্তিকে আধুনিক মানুষে পরিণত করে। রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে আমার ভেতর এ বোধের সৃষ্টি করত কে?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-‘বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে’। এই ডাগর আঁখি দিয়ে তিনি নিরন্তর পর্যবেক্ষণ করেছেন জোড়াসাঁকো, বোলপুর, শিলাইদহ, পতিশর আর শাহজাদপুরের জীবন ও প্রকৃতি। তিনি না জন্মালে কে আমাদের ‘নিবিড়ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা’ বলে আস্থা যোগাত? তাঁর দেখার চোখ দিয়েই তো আমরা দেখতে শিখেছি ‘কান্নাহাসির দোলায়’ দোলায়িত জীবন। তাঁর ডাগর আঁখি দিয়েই তো ঋতু বৈচিত্রের এই দেশে আমরা ষড়ঋতুর রূপ চিনেছি। ‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার’ কিংবা ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’ বলে তিনি বাঙালিকে পরিশীলিত প্রেমের সংলাপ শিখিয়েছেন। তিনি না জন্মালে কে আমাদের ক্রান্তিকালে পাশে থেকে ‘সংকটেরও কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ’ বলে প্রেরণা জাগাত?
হাজার বছরের অচলায়তন ভেঙে রাজা রামমোহন রায় ‘সতীদাহ প্রথা রোধ’ করে এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বিধবা বিবাহ প্রচলন’ করে বাঙালি নারীর জন্য দু’টো যুগান্তকারী কাজ করে গেছেন। আর, রবীন্দ্রনাথ আমাদের ঘরে ‘নোবেল’ এনে দিয়েছেন। তিনি না জন্মালে আমাদের সাহিত্য কোনও দিন ‘নোবেল’-এর মুখ দেখত না। তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে উন্নীত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে বাংলা সাহিত্য আজও ‘আলালের ঘরের দুলাল’ আর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তেই আবদ্ধ থাকত। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিকড় এতই গভীরে প্রথিত করে গেছেন যা কোনও ভাবেই উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মাস্টার মশাই। তাঁর গান-কবিতা বাঙালিকে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ শিখিয়েছে। তিনি আমাদের আধুনিক নাগরিক ভাষা লিখতে এবং বলতে শিখিয়েছেন। তিনি না জন্মালে কে আমাদের আদর্শ বাংলা ভাষা (মান ভাষা) শেখাত? রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে আমাদের কে শেখাত, সমষ্টিগত কিংবা ব্যক্তিক জীবনের সকল সংকট ও সম্ভাবনায় কী ভাবে স্থিতধী বৃক্ষের মতো অবিচল থাকতে হয়? আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরেই হাঁটি।
রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিবিদ ছিলেন না কিন্তু তিনি রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। তাঁর একটা সুস্পষ্ট পলিটিকাল আইডিওলজি ছিল। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের পর ইংরেজ সরকার প্রদত্ত খেতাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বাঙালিকে শিখিয়েছেন, সময়ের প্রয়োজনে কী ভাবে স্পর্ধিত হতে হয়। তিনি না জন্মালে কে আমাদের শেখাত, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ মানুষের মেরুদণ্ড কতখানি ঋজু ও শক্ত হওয়া প্রয়োজন?
বিশ্ব-অর্থনীতিতে ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ বা ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ ঝড় বইয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’-এর প্রণেতা। তিনি না জন্মালে ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ শব্দটির সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় ঘটত না। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির রুচিবোধ তৈরি করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত দুঃখ-শোককে কী ভাবে অন্তরে ধারণ করতে হয় সেই মহোত্তম শিক্ষাটাও তিনিই আমাদের দিয়েছেন। আমরা কোন ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করব, কোথায় থামব, বেদনায় কতখানি লীন হব, তার সীমারেখাও তিনিই নির্দিষ্ট করে গেছেন। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ কিংবা ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ লিখে তিনি দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার পাশাপাশি আমাদের দেশপ্রেমের শিক্ষাটাও দিয়ে গেছেন।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে উত্তাল সমুদ্রে হাল ভাঙা নাবিককে পথ চিনে তীরে ফিরিয়ে আনে ‘লাইট হাউস’। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সেই ‘লাইট হাউস’। ‘নিবিড় ঘন আঁধারে’ তিনিই আমাদের ধ্রুবতারা। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার ফাঁকে তিনি ধ্রুবতারা যার আলোয় বাঙালি কখনো দিগভ্রান্ত হবে না, সঠিক পথটি চিনে নেবে। অর্থাৎ, শেষ দিনটি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে অপরিহার্য।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

