- August 13th, 2022
পূর্ণকুম্ভ, শূন্য মন (তৃতীয় পর্ব)
পূর্ণকুম্ভ, শূন্য মন
সুমন চট্টোপাধ্যায়
(তৃতীয় পর্ব)
কোথায় সেই প্রয়াগের প্রান্তরে তাঁবুর ভিতর বিচুলির বিছানা— ‘আর কোথায় হরিদ্বারের এই হোটেল!’ তিন মাস আগে চারগুণ ভাড়ার পুরোটা অগ্রিম দিয়ে এই হোটেলের ঘর সংরক্ষণ করতে হয়েছিল আমাদের। কুম্ভমেলায় এই হোটেলবাস ক্ষুব্ধ আর বিচলিত করেছিল কালকূটের মনকে। সেই অসহায় ক্ষোভ ব্যক্ত করেই তো অননুকরণীয় স্টাইলে কালকূট আনন্দবাজারে লিখেছিলেন, ‘এ-পান্থশালাকে আমি রাজসিক আখ্যা দিয়েছি। দেবার আগে ভারতের প্রধান আর প্রথম শ্রেণির নগরবাসীদের কাছে জোড় হাতে ক্ষমা চাই। এ-পান্থশালার রাজসিকতার সঙ্গে, হে মহাশয়গণ, অয়ি নগরনন্দিনী মহাশয়াগণ, কদাপি আপনাদিগের পঞ্চতারকা বা সপ্ততারকার কল্পনাও করিবেন না। হায়, কক্ষ প্রশস্ত। শয্যা অসুখকর বলা যায়, কক্ষ-সংলগ্ন স্নান ও প্রাতঃকৃত্যাদির মোটামুটি ব্যবস্থা সম্পন্ন একটি প্রকোষ্ঠও রহিয়াছে। অতঃপর আমার এই নম্র সাধু ভাষার কারণটি নিবেদন করি। পূর্ণ কুম্ভের প্রায় কোটি মনুষ্য-সমাগমের সুযোগে পান্থশালার মালিক এখন প্রতি কক্ষের নিমিত্ত পঞ্চ আর সপ্ততারকা পান্থশালার মূল্য শুষিয়া লইতেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে তারও বেশি বই কম না। এ সংবাদের মধ্যে বিত্তের অহঙ্কার নেই। আছে বিড়ম্বিতের হতাশা। দেহমনের যে অনিবার্য পরিবর্তন আমাকে দিয়েছে সহজ-গ্রাহ্য শক্তি, হরিদ্বারের পান্থশালায় বসে সেই অনিবার্য পরিবর্তনই আজ বড় পীড়া দিচ্ছে।’
টাইপরাইটারে বসে, তোমার ওই খুদে খুদে বাংলা অক্ষরগুলি আবার রোমান হরফে রূপান্তরিত করতে আজ সেদিনের সেই অবিশ্বাসী যুবা সঙ্গীর মনও কতটা পীড়িত আর বিচলিত হচ্ছে, তা যদি তুমি জানতে হে কালকূট! আমার টেবিলের ওপর চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে তোমারই স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপির সেই পাতাগুলো। যাত্রাশেষে যা তুমি আমাকে উপহার দিয়েছিলে। কালো কালিতে লেখা খুদে খুদে হরফে। তোমার চেহারার মতোই সুন্দর তোমার হস্তাক্ষর, তোমার চুলের মতোই ঘন, কোঁকড়ানো, আর কলম চুঁইয়ে পড়া প্রতিটি শব্দের ভেদশক্তি। তোমার আয়ত দুই চোখের দৃষ্টির চেয়েও তীব্র। কিন্তু আজই এত তাড়াতাড়ি এই সব কথা লিখতে হবে কে জানত? মাঝখানে কেটে গিয়েছে পাক্কা দু’টি বছর। কিন্তু চোখ বুজলে মনে হয়, এই তো সেদিন।
অফিসের অতিথিশালা ছাড়িয়ে গাড়ির চাকা রাস্তায় নামতেই কালকূটের মেজাজ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাসন্তী সকালের ফিকে রৌদ্রের কিরণ গেলে জ্বলজ্বল করছিল দু’টি চোখ। কালকূটের ফণার মণির মতনই। স্ফূর্তিতে গুন গুন করে গানও ধরেছিলেন। ‘যাত্রী আমি, ওরে যাত্রী আমি, পারবে না কেউ আমায় রাখতে ধরে।’ ধরে রাখার কথা তো ছিলই, আরও কথা ছিল প্রতিদিনের রোজনামচা কালকূটের কাছ থেকে আদায় করা। ‘পারব না হে বাপু রোজ রোজ লিখতে। আমি তো আর তোমাদের মতো দৈনিক কাগজের রিপোর্টার নই।’ আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গিয়েছিল কালকূটের কথা শুনে। ‘অন্তত আমার চাকরিটা বাঁচানোর জন্য আপনাকে রোজ লিখতেই হবে। কাগজে বারবার করে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে গিয়েছে ‘কালকূট লিখছেন আনন্দবাজারের জন্য’।’ আমার কণ্ঠে অসহায় মিনতির সুর শুনে ওষ্ঠে সেই পরিচিত রহস্যময় হাসি এনে কালকূট ততোধিক রহস্যজনক জবাব দিয়েছিলেন, ‘আগে চলো তো, পরে দেখা যাবে।’
পরে হরিদ্বার পৌঁছে বুঝেছিলাম সেটা ছিল নেহাতই কথার কথা। ঘড়ি আর আমার উৎপীড়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফি-রোজ তিনি যে ভাবে লেখা শেষ করতেন গণ মাধ্যমের বহু ‘টাইপরাইটার গেরিলাকে’ তা লজ্জা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এক কোটি মানুষের কুম্ভে ছিল বিভীষিকাজনক অব্যবস্থা। কুম্ভ স্নানের দিন সেতু ভেঙে যার মূল্য দিতে হয়েছিল পঞ্চাশজন পুণ্যার্থীকে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দুদের ওই ‘বিশ্ব সম্মেলন’ ‘কভার’ করতে হরিদ্বার এসেছিলেন কয়েকশো সাংবাদিক। তাঁদের থাকার জন্য কোনওমতে একটা ক্যাম্প করা হলেও প্রতিবেদন পাঠানোর সুব্যবস্থা ছিল না। অস্থায়ী পোস্ট অফিসের সবেধন নীলমণি টেলিফোনটিও বিকল হয়ে থাকত অর্ধেক সময়। অতএব বাধ্য হয়েই আমরা চড়া দাম দিয়ে যুবক এক বার্তাবাহককে জোগাড় করেছিলাম। সে রোজ বিকেল তিনটের বাসে কালকূট আর আমার প্রতিবেদন নিয়ে হরিদ্বার থেকে দিল্লি আসত, আমাদের অফিসে সেগুলি পৌঁছে দিতে। দিল্লি থেকে টেলিপ্রিন্টারে সে লেখাগুলি পোঁছত কলকাতা অফিসে। রাতের বাসেই ফিরত হরিদ্বারের দিকে, পরের দিন আবার। এ ভাবেই ন’টা দিন হরিদ্বার আর দিল্লির মধ্যে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করত মৃদুভাষী সেই ক্ষীণ চেহারার যুবকটি।
অতএব আমার হাতে কালকূটকে লেখা তুলে দিতে হত সকাল ১১টার মধ্যে। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্যাদি আর স্নান শেষ করেই লিখতে বসতেন, ড্রেসিং টেবিলের টুলের ওপর। সেন্টার টেবিলে কাগজ পেতে। কালকূট যতক্ষণ লিখতেন টুনি বৌদি এসে বসে থাকতেন হয় আমার নয় শীর্ষেন্দুদার ঘরে, ভয়ে গুটিসুটি মেরে। ‘বুঝলি, লেখার সময় বাঘ। বাঘের মুখে থাকতে নেই বলেই তোদের ঘরে চলে আসি। তোরাও যাস না’— বৌদি বলতেন। তবু আমায় যেতে হত, কাজ তাড়াতাড়ি সারার তাগিদে। একদিন লিখতে বসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে অর্ধেক পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এনেছিলাম, পাল্লা দিয়ে রোমান হরফে রূপান্তরিত করব বলে। তা দেখে বৌদি আবার বলেছিলেন, ‘ছোকরার বলিহারি সাহস। জানিস তুই যে কাজ করেছিস তার জন্য তোর পরমবীর চক্র পাওয়া উচিত।’
লেখার সময় ফণা উঁচিয়ে থাকবেন কালকূট। তখন সেখানে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু একটা লালমুখো ইয়া লেজওয়ালা হনুমান হোটেলের বারান্দার রেলিং টপকে সময়-অসময়ের কথা না ভেবেই সকালের দিকে আসত ওঁর ঘরে। নিয়মিত। প্রথম দিন এসে কয়েকটা সন্দেশ পেয়েছিল। তাই। দু’বেলা আহারের পর মিষ্টিমুখ করা ছিল কালকূটের অনেক আসক্তির মধ্যে একটি। হোটেলের মিষ্টি পছন্দ হত না বলে বৌদি বাইরের দোকান থেকে রোজ সকালে তা কিনে রাখতেন। আর হনুমানটা আসত তারই সন্ধানে। রোজ তাকে নিজের বরাদ্দের একটা সন্দেশ দিতেন কালকূট। আর রসিকতা করে বলতেন, ‘কী করব, পূর্বপুরুষ যে!’
কিন্তু কী লিখবেন? মনের ইচ্ছে তো রেলিং টপকে রাস্তায় লাফ দিয়ে রূপসাগরের কোটালের বানে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া। সেই যে ভাবে বত্রিশ বছর আগে প্রয়াগ-সঙ্গমে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তো হারিয়ে যাওয়ায় মানা আছে। ঘরণীর মানা, ডাক্তারের মানা, বেহায়া সঙ্গীর মানা। ঠিক যেন সেই পাখির অবস্থা, খাঁচায় থাকতে থাকতে যার ডানা দুটো অবশ হয়ে গিয়েছে। উড়তে চায়, পারে না। ওষুধে সচল হৃৎপিণ্ডের সেই যন্ত্রণাদায়ক ছটফটানি ছিল বলেই তো প্রথম রাতে হোটেলের সুখশয্যায় পাখি ঘুমোতে পারেনি। সকালের চটকা ভেঙে উঠেই রাত জেগে দেখা সেই কোটালের বানকে উদ্দেশ করে কালকূটকে তাই লিখতে হয়েছিল, ‘জানি, ভালো করেই জানি, আমি সেই লক্ষ মানুষের সঙ্গে নেই। রূপসাগরের কোটালের বাণী কেবল আমার চোখে।’
ঘোলে মেটে না দুধের স্বাদ। তবু রেল স্টেশনের উল্টোদিকে আমাদের হোটেলের দোতলার বারান্দায় বসে থেকেও মনটাকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন নীচে, নিরন্তর জনতার স্রোতে। ওই গুঞ্জনে কান পেতে বুঝতে পেরেছিলেন, পায়ে ধুলো উড়িয়ে কাতারে কাতারে গঙ্গার ধারে যাচ্ছে যারা, তারাও শান্তিতে নেই। ‘পান্থশালার দ্বিতলের বারান্দার মানুষটার অবাক-মুগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে, তোমাদের হাসির মধ্যে যে কৌতূহল, জিজ্ঞাসার সঙ্গে একটা আবেগ আর উচ্চাশাও আছে, এই রাতের উজ্জ্বল আলোয় তা দেখতে পাচ্ছি। তোমাদের প্রাণে যে শক্তি, এই হাসি-উচ্ছ্বাস সেই শক্তির প্রকাশ। একটু কি করুণাও করে যাচ্ছ? তোমরা চলেছ যে স্রোতধারার পথে, আমি সেখানে কেবল দাঁড়িয়ে আছি। সংসার কোনও দিন জানবে না তোমাদের হাসি। কথা আর কিছু না। তোমরা ভাবছ বেকুবটা ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছে? ও কি আসবে না আমাদের সঙ্গে? তোমার ভিতরের ওই ডাকের মধ্যে আর এক রূপে যে দেশেরও ডাক আছে, সেই বিস্ময়কর সুখের সংবাদ এই কঠিন সমাজ-সংসার কোনও দিন জানতে চায়নি। বুঝতে পারেনি বলেই যাদের বুঝতে দিয়েছ, তাদের (আমাদের) কথায় ওদের ঠোঁটের হাসি বিদ্রুপে বাঁক খেয়ে যায়। অবিশ্বাসটা চাপতে পারে না। অথচ ওদের বুকে কান না পেতেও, কান পেতে শুনেছি ওদের মনে অসুখ। অশান্তিতে ভুগছে।’
কালকূটের অশান্তি, ‘ভিতরটা কেবলই আমাকে নীচে নামিয়ে রাস্তার ধারে নিয়ে যেতে চাইছে। বাইরেটা চোখ পাকিয়ে সাবধান করছে। বলছে, মনে রেখো, এটা বত্রিশ বছর আগের সেই দিন না। সুস্থ থাকো, বাঁচো, দ্যাখো।’ (আগামী পর্বে সমাপ্য)

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

