- August 13th, 2022
যদির কথা নদীতে
নিরানন্দর জার্নাল (২১)
যদির কথা নদীতে
সুমন চট্টোপাধ্যায়
পিসির গোঁফ থাকলে বাবারা চার ভাই হতেন, এই জাতীয় আলোচনা অবশ্যই বুরবকের কম্মো। কী হলে কী হতে পারত, ইতিহাস তার ধার ধারে না, যা হয়েছে সেটাকেই কাটাছেঁড়া করা তার কাজ।
তবু আমরা কাল্পনিক সম্ভাব্যতার ফাঁদে বারেবারে পা দিই, দিতে ভালবাসি, কেন না আকাঙ্ক্ষা অথবা আকুতি এমনই দুর্মর, বেদনাদায়ক অনভূতি যা বাস্তবের সরলরেখা বরাবর চলে না, চলতে পারে না। তাঁর জার্নালে Susan Sontag যেমন লিখেছিলেন, ‘My library is an archive of longings’!
এই longing বা আকাঙ্ক্ষা কী বিষম বস্তু তা আরও সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছিলেন ফার্নান্দো পেসোয়া, বিশ্ববন্দিত পর্তুগিজ কবি। “The feelings that hurt most, the emotions that sting most are those that are absurd. The longing for impossible things, precisely because they are impossible; nostalgia for what never was, the desire for what could have been, regret over not being someone else, dissatisfaction with the world’s existence— all these half tones of the soul’s consciousness create in us a painful landscape, an eternal sunset of what we are.’
হতে পারে ধূমপান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে আমি যে খেদোক্তি করে ফেলেছিলাম অবচেতনে তারও উৎসে আছে অসম্ভবকে অসম্ভব জেনেও আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করতে না পারা। আমি লিখেছিলাম, বুদ্ধদেব সুস্থ, সচল থাকলে খেলাটা অন্য রকম হত, হতই। যে খেলা খেলাই হবে না, হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনও সম্ভাবনা নেই, তাকে নিয়ে জল্পনা কিছুটা অলীক তো বটেই। এটাও আসলে
আত্মিক চেতনার একটি হাফ-টোন রেখা যা মনের মধ্যে চরম বেদনাদায়ক একটা ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করে।
আমার এই মন্তব্য যে পাঠকের চিত্ত-চাঞ্চল্যের কারণ হয়ে উঠতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি। অথচ সেটাই হয়েছে, কেউ জাত-ক্রোধে সম্ভাবনাটি নস্যাৎ করে দিয়েছেন, কেউ আবার হোয়াটস অ্যাপে ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠিয়ে সবিনয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘দাদা, আপনি যা লিখেছেন তা কি সত্যিই সম্ভবপর হত?’ দেখে ভালো লাগল অসম্ভবের সম্ভাব্যতা নিয়ে আমি একা নই, অনেকেই চিন্তা-ভাবনা করেন। অসংখ্য মানবিক দুর্বলতার মধ্যে এটিও একটি।
আমার এই নিজস্ব ভূখণ্ডে আমি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ছায়াপাতও ঘটাতে দিই না, সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাই। বলতে পারেন, অর্থনীতির ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’ এখন আমার ক্ষেত্রে কাজ করছে, সারাটা জীবন ধরে এত রাজনীতির লেবু কচলিয়েছি যে এখন মুখটা তিক্ত-স্বাদে ভরাট হয়ে আছে। বঙ্গ-সমাজে রাজনীতির প্রাবল্য এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি, আমার বিশ্বাস বাঙালির সবচেয়ে কদর্য চেহারাটাও এই রাজনীতির আসরেই বে-আব্রু হয়ে যায়। আর যে ক’টা দিন বাঁচব, রাজনীতি দিয়ে মনকে আর ভারাক্রান্ত করব না। রাজনীতির বাইরেও যে একটা জীবন আছে, সেটাও যে কম উত্তেজক, চিত্তাকর্ষক নয়, আমার মতো করে, আমার একক ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে আমি সেই সত্যটিই প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
বাংলাস্ফিয়ারের অনুচ্চারিত স্লোগান হল, ‘সে নো টু ইন্ডিয়ান পলিটিকস।’
আজ প্রথম এবং সম্ভবত শেষবারের মতো আমি প্রতিজ্ঞা থেকে কিছুটা সরে আসছি আত্মপক্ষ সমর্থনের তাগিদে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুস্থ ও সচল থাকলে খেলাটা অন্য রকম হতে পারত কেন, তা নিয়ে যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে দু’চার কথা বলতে।
১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসু যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন, তাঁর বয়স ছিল তেষট্টি। ২০১১ সালে নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন স্বেচ্ছা বাণপ্রস্থে চলে গেলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র সাতষট্টি। সচেতন ভাবে ‘মাত্র’ বললাম, কেন না শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে বিশেষ করে রাজনীতিতে ৬৭ কোনও বয়সই নয়। কিছুদিন আগেও একটি চালু রসিকতা ছিল, সত্তর না টপকালে কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে পলিটব্যুরোর সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনই করেন না। আমরা একেই বলতাম ‘জেরোন্টোক্রাসি’ বা বৃদ্ধতন্ত্র। রেজ্জাক মোল্লা দেহাতি স্টাইলে কটাক্ষ করতেন, ‘নেতৃত্বে সবই তো আমাদের পাকা চুল।
২০১১ সালের পরে গত দশ বছরে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আমার একবারও কথা বলার অবকাশ হয়নি, ফলে হঠাৎ করে তাঁর অন্তরালে চলে যাওয়ার কাহিনি আমার অজানা। তবে এটুকু জানি তিনি খুবই অভিমানী মানুষ, যাদবপুর কেন্দ্রে মণীশ গুপ্তর কাছে পরাজয় তিনি গোড়ার দিকে মানতেই পারেননি। হতে পারে, বুদ্ধবাবুর মনে হয়েছিল, তাঁর আগ্রাসী শিল্পায়নের নীতিই দলকে জন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ভরাডুবির পথ প্রশস্ত করেছে, অতএব পরাজয়ের নৈতিক দায় তাঁরই।
বঙ্গজ কমিউনিস্টরা ভাঙা রেকর্ডের মতো একটা বুলি আওড়ে চলেছেন জন্ম-জন্মান্তর ধরে। কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যক্তি খুবই তুচ্ছ ব্যাপার, আসল কথা হল দল। আমি কখনও এ কথা মানিনি, আজও মানি না। মাও সে তুংকে বাদ দিয়ে চিনা বিপ্লবের কথা ভাবা যায়? লেনিনের কথা বাদ দিয়ে রুশ বিপ্লবের? কাস্ত্রোকে বাদ দিয়ে কিউবা বিপ্লব হয়? জ্যোতি বসু-প্রমোদ দাশগুপ্তকে বাদ দিয়ে কমিউনিস্টরা কি বাংলায় আদৌ ক্ষমতায় আসতে পারত? দলের গুরুত্ব অস্বীকার না করেও তাই ব্যক্তিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হয়, কেন না ব্যক্তির জন্য দল গড়ে ওঠে, উল্টোটা নয়।
বুদ্ধদেববাবু হঠাৎ অন্তরালে চলে যাওয়ায় বাম-শিবিরের নেতৃত্বে যে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে, গত দশ বছরে তা ভরাট করার মতো একটি মুখও উঠে আসেনি। অথচ যত দিন যাচ্ছে ভোটের রাজনীতি তত বেশি করে আবর্তিত হচ্ছে নেতা অথবা নেত্রীর ভাবমূর্তি, গ্রহণযোগ্যতা, জনমনহরণী শক্তিকে কেন্দ্র করে। ভোট হয়ে দাঁড়াচ্ছে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নেতৃত্বের প্রশ্নে গণভোট। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী, ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক, বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই গণভোটেরই বিজয়ী মুখ। এই যেখানে বাস্তব পরিস্থিতি সেখানে কোনও শিবির যদি নেতার মুখ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়, তাদের পালে হাওয়া লাগা অসম্ভব। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যদি সেই মুখ হিসেবে রয়ে যেতেন, খেলাটা এতটা একতরফা হতে পারত না কিছুতেই। তাঁর নেতৃত্বে বামেরা ফের ক্ষমতায় হয়তো আসত না কিন্তু প্রতিপক্ষ কি ফাঁকা গোলে বারবার এ ভাবে বল পাঠাতে পারত?

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

