- August 13th, 2022
সিগার, সিগারেট, পাইপ
নিরানন্দর জার্নাল (২০)
সিগার, সিগারেট, পাইপ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
দু’আঙুলের ফাঁকে সিগার নেই, ফিদেল কাস্ত্রোর এমন একটি ছবি কল্পনা করতে পারেন? কিংবা উইনস্টন চার্চিল? কিংবা অ্যালফ্রেড হিচকক? কিংবা আমাদের ঘরের কাছে প্রমোদ দাশগুপ্ত বা জ্যাকি’দা? গোঁফ দিয়ে নয়, এঁদের চেনা যায় সিগার দিয়ে।
সিগার-স্মোকার বিখ্যাতদের তালিকা লিখতে বসলে তা ক্লান্তিকর রকমের দীর্ঘ হয়ে যাবে। জন এফ কেনেডি, মার্ক টোয়েন, গ্রুচো মার্কস, বিল ক্লিন্টন, মাইকেল জর্ডান, আর্নল্ড শোয়াৎসনেগার, রুডিয়ার্ড কিপলিং, জে পি মর্গান, সিগমন্ড ফ্রয়েড, হ্যারিসন ফোর্ড, টম ক্রুজ, চে গুয়েভেরা ও চার্লি চ্যাপলিন…। সিগার-স্মোকারদের একটা হল অব ফেম বানানোর ভাবনা এখনও কারও মস্তিষ্কে আসেনি কেন কে জানে।
এঁদের সবার মধ্যে রীতিমতো দাদাগিরি করে ধূমপান করতেন চার্চিল। সুখাদ্য, সু-পানীয় আর সিগার, এই ত্র্যহস্পর্শে ঘেরা ছিল তাঁর জীবন। সারা দিনে দশ-বারোটা সিগার প্রয়োজন হত তাঁর, অবশ্যই কিউবান ব্র্যান্ড। বিমানের নন-প্রেসারাইজড কেবিনে অনেক উচ্চতায় বসেও তিনি যাতে ধূমপান করতে পারেন, তার জন্য বানানো হয়েছিল বিশেষ ধরনের অক্সিজেন মাস্ক। একবার সৌদি আরবের তদানীন্তন রাজা ইবন সৌদকে মধ্যাহ্নভোজনে নিমন্ত্রণ করেছিলেন চার্চিল। তাঁর সামনে কেউ ধূমপান অথবা মদ্যপান করুক সৌদি-রাজ তা একেবারেই বরদাস্ত করতেন না। চার্চিলের পাল্লায় পড়ে তাঁর গুমোর ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল। অনেকটা শাদির রাতে বেড়াল মারার মতো করে ভোজনের টেবিলে বসেই চার্চিল রাজাকে শুনিয়ে দিলেন, ‘My rule of life prescribed as an absolutely sacred rite smoking cigars and also the drinking of alcohol, before, after and if need be during all meals and in the intervals between them.’ সৌদি রাজার মিডল স্টাম্প ছিটকে উইকেটকিপারের সামনে পড়ার জোগাড়!
স্বাস্থ্যের অবনতির চিহ্নগুলি স্পষ্ট হতে থাকায় ফিদেল ধূমপান ত্যাগ করেন ১৯৮৫ সালে, টানা চুয়াল্লিশ বছর সিগারকে অবলম্বন করে বাঁচার পরে। কাস্ত্রো নিজেই কবুল করেছেন, ‘রাতের স্বপ্নে আমি প্রায়ই দেখতাম সিগারে সুখ-টান দিচ্ছি। সকালে উঠে এ জন্য আমি নিজেই নিজেকে তিরস্কার করতাম। তাতে কি, সিগার-টানার স্বপ্ন দেখা তো বন্ধ হল না।’ ফিদেলের গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি চে গুয়েভেরা মনে
করতেন, পাহাড়ে, জঙ্গলে নিঃসঙ্গ গেরিলার সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী হল সিগার।
কাট টু কলকাতা। এ শহরে সিগারের মৌতাত উপভোগ করতে আমি দু’জনকে দেখেছি, বসন্ত চৌধুরী আর অভীক সরকার। দু’জনেই অভিজাত, কেতাদুরস্ত, শৌখিন, সামাজিক ও আড্ডবাজ মানুষ। বসন্তবাবু কোন ব্র্যান্ডের সিগার খেতেন বলতে পারব না, অভীকবাবুর ব্র্যান্ডের নামটি ছিল মন্টি-ক্রিস্টো, কিউবান সিগার, তাঁর টেবিলের ওপর একটা অপরূপ মেহগনি কাঠের বাক্সে সিগারগুলি থরেথরে রাখা থাকত। বেশ লম্বাটে, ধূসর বর্ণ, চিকনের মতো মসৃণ। সিগারের একটা মুখ ক্লিপার দিয়ে কেটে তবে অন্য মুখে অগ্নি-সংযোগ করতে হত। শখ যেমন ঝক্কিও তেমনি। একবার বিদেশের কোনও এক ডিউটি ফ্রি শপে মন্টিক্রিস্টো সিগার দেখে আহ্লাদ হয়েছিল এক বাক্স কিনে সম্পাদককে উপহার দেওয়ার। কাছে গিয়ে কাঞ্চন-মূল্যটি দেখার পরে মনে হল যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম, ছিটকে বেরিয়ে এলাম দোকানের বাইরে।
মালিকরা যতদিন নিজেরা ধূমপান করতেন আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। যেই তাঁরা বদভ্যাস ছাড়লেন ওমনি রাতারাতি গোটা অফিস নো স্মোকিং জোন হয়ে গেল। আমাদের রোজকার শাস্তি ছিল বারেবারে লিফটে করে নীচে ফুটপাথে নেমে বিড়ি ধরানো। টেলিগ্রাফ, সানডে-র বেশ কয়েকটি মেয়েও ছিল ফুটপাথ-স্মোকার। পথচারীদের কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে এমন ভাবে মেয়েদের দেখত যেন চিড়িয়াখানায় নতুন জন্তু দেখতে এসেছে। কেউ কেউ আবার দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে পড়ে, চোখ কচলিয়ে বোঝার চেষ্টা করত চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করছে তা কি মায়া না সত্য!
অভীকবাবুকে নাকের বদলে নরুন দিতে পেরেছিলাম অবশ্য। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস যখন কলকাতা থেকে ইয়াঙ্গন বিমান সেবা শুরু করল, প্রথম উড়ানে যাত্রী ছিলাম কেবল কলকাতার বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এখনকার মতো তখনও মায়ানমারে ফৌজি জমানা, অং সাঙ সু চি গৃহবন্দি, পদে পদে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা। রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে বাড়িতে থাকতেন, খুঁজে খুঁজে সেখানেও কড়া নেড়েছিলাম। ফেরার আগে স্থানীয় বাজারে গিয়ে দেখি, ঢালাও বর্মা চুরুট বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে দামী এক বান্ডিল চুরুট কিনে কলকাতায় ফিরে সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
সিগার আর চুরুট এক বস্তু নয়, বড় জোর তুতো ভাই। চুরুট দামে তুলনায় সস্তা, তেজে অনেক বেশি কড়া। একটা সময় এই কলকাতার তিন মহারথী এই বর্মা চুরুট খেতেন, ধর্মতলার একটি দোকানে কিনতে পাওয়া যেত। দোকানে স্টক শেষ হয়ে গেলে এঁরা যে যাঁর নিজের স্টক থেকে বাকিদের বিলি করতেন। প্রমোদ দাশগুপ্ত, যতীন চক্রবর্তী আর গৌরকিশোর ঘোষ। মতাদর্শগত অবস্থান যাই থাকুক এই ত্রিমূর্তির চুরুট-ঐক্য ছিল সাঙ্ঘাতিক মজবুত।
স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ধূমপায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রফুল্ল ঘোষ নন, বিধান রায় নন, প্রফুল্ল সেন নন, অজয় মুখোপাধ্যায় নন, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় নন, জ্যোতি বসু নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না। ভাবলে অবাক লাগে বুদ্ধবাবুর সমবয়সী কমরেডদের অনেকে কিন্তু ধূমপান করতেন না।
যেমন অনিল বিশ্বাস বা সুভাষ চক্রবর্তী, তবে এঁরা দু’জনে নস্যি নিতেন। ধূমপায়ীদের মধ্যে সাধারণত দু’টি গোত্র থাকে, একদল যাঁরা সিগারেট খান আর একদল সিগারেটই যাদের খেয়ে নেয়। ডাক্তারদের উপর্যুপরি সাধানবাণী, শুভাকাঙ্খীদের আবেদন-নিবেদন অগ্রাহ্য করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে দ্বিতীয় দলে নাম লেখালেন সেটা অতীব দুর্ভাগ্যের। তাঁর নিজের, দলের, সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গের। তিনি সুস্থ ও সচল থাকলে খেলার চেহারাটা অন্য রকম হত। হতই।

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

