- August 13th, 2022
প্রাণ চায় তাই প্রাণও যায়
নিরানন্দর জার্নাল (১৮)
প্রাণ চায় তাই প্রাণও যায়
সুমন চট্টোপাধ্যায়
পুলিশ, দমকল আর মিডিয়ার মধ্যে একটি জায়গায় মিল আছে, তিন পক্ষই আদতে অঘটনের কারবারি। আগুন লাগলে দমকল, মারপিঠ বাধলে পুলিশ, আর মিডিয়া সর্বত্র। সাংবাদিকতার একেবারে প্রথম পাঠে শেখানো হয়, কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর নয়, উল্টোটা ঘটলে সেটা। যদিও আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোথাও মানুষ কুকুরকে কামড়েছে, এমন ঘটনার কথা শোনা যায়নি।
আবার মস্ত বড় একটি মৌলিক পার্থক্যও আছে। কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেলে দমকল অথবা পুলিশের চাকরিতে ক্ষতিপূরণ আছে, নিকটাত্মীয়ের চাকরির সম্ভাবনা আছে, সবার ওপরে পেনশন আছে। একই ঘটনা যদি কোনও রিপোর্টারের ক্ষেত্রে ঘটে? মালিক সঙ্গে সঙ্গে চোখ-পালটি করবে, পাঁচ পয়সা ক্ষতিপূরণও দেওয়া হবে না, দিন কতক পরে একটি শোকসভা সাঙ্গ হলে সবাই বিষয়টি ভুলে যাবে। বেঘোরে যাওয়া প্রাণটি চলে যাবে বিস্মৃতির অতলে।
কাজ করতে গিয়ে কতটা ঝুঁকি নেব বা নেব না, আমার মনে হয়, এই বৃহত্তর বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে তা বিচার করা উচিত। যার জন্য জান কবুল করব তার কাছেই আমার প্রাণের মূল্য যদি ফুটো পয়সা হয়, আমি খামোখা গ্যাস খেয়ে ক্ষুদিরাম হতে যাব কোন দুঃখে? পাঁচ মিনিটের খ্যাতি বড় না সাধের পরাণ, এই বিবেচনাটি মস্তিষ্কে রাখা জরুরি।
ইদানীং দেখি সাংবাদিকদের গাল পেড়ে অযুত লোকে গায়ের ঝাল ঝাড়ে, ঘৃণিত পেশার মধ্যে রাজনীতির মতোই ঢুকে পড়েছে সাংবাদিকতাও। এই কটূক্তি সাংবাদিকের একেবারেই প্রাপ্য নয় একথা বলছি না, মালিক ধরে আনতে বললে এরা অনেকে বেঁধে আনে, অসত্য, অর্ধসত্যকেও গলা ফাটিয়ে সত্য বলে চালাতে এদের এতটুকু বিবেক দংশনও হয় না। এবারের বিধানসভা ভোটে এমন পক্ষপাতমূলক কভারেজের বিবিধ দৃষ্টান্ত সকলের গোচরে এসেছে। এই প্রবণতা যত বাড়বে, সমানুপাতিক হারে কমবে মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা।
এখনই সেটা তলানিতে এসে ঠেকেছে, মাঝে মাঝে ভয় হয় গণতন্ত্রের এই চতুর্থ স্তম্ভটি না অচিরেই ফিফথ কলামনিস্টে পর্যবসিত হয়।
এবার সাংবাদিকের অসহায় দুরবস্থার ওপর আলো ফেলা যাক। এই পেশা থেকে স্থায়ী চাকরি বহুদিন হল উঠে গেছে, সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকে ঝির পর্যায়ে। চুক্তি-ভিত্তিক চাকরি, বাবুদের একটা টেলিফোনে রাম রাম হয়ে যেতে পারে। কলকাতারই এক নামী কাগজে কিছুদিন আগে একটা হোয়াটস অ্যাপ কলে নয়-নয়জন সাংবাদিকের চাকরি সঙ্গে সঙ্গে নট হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদ করার কেউ নেই, পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, ইউনিয়নগুলি কালাধারে চলে গিয়েছে, প্রেস ক্লাব হয়ে দাঁড়িয়েছে সস্তার শুঁড়িখানা। অস্তিত্বের এমন বিপন্নতার মধ্যে সাংবাদিককুল কখনও পড়েনি, ইংরেজ আমলেও নয়। এমন ভয়ানক অনিশ্চিতির মধ্যে যাদের কাজ করতে হয়, কোম্পানির বেঁধে দেওয়া লাইনের বাইরে যাওয়ার তার কোনও উপায় নেই। বিবেক, বুদ্ধি, বিচারকে বাড়িতে ছাড়া জামা-প্যান্টের সঙ্গে রেখে এসে আজকের সাংবাদিক অফিসে ঢোকে। বাড়ি ফেরার সময় ভাবে, যাক বাবা, আজকের মতো চাকরিটা রয়ে গেল।
তবু সাংবাদিকতার নেশায় একবার যে মজেছে, ভালো স্টোরি দেখলে যার শরীরের শিরায় রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, কাজে নেমে সে অনেক সময়ই দিকবিদিকশূন্য হয়ে যায়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ অনেকটা যেন নিশির ডাক, একবার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে তাকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যায় না। কলকাতা টিভি-র মেয়েটির ক্ষেত্রে আজ ঠিক সেটাই হয়েছে। মেয়েটি জাত রিপোর্টার, পিছনে সমুদ্রের বিস্ফোরক জলোচ্ছাসকে অগ্রাহ্য করে তার মনে হয়েছে, আরও একটু দেখি, আরও একটু দেখি। আমি নিশ্চিত কেউ ওকে অপেক্ষা করতে বাধ্য করেনি, করবেও না। এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই দেবতার গ্রাস হয়ে জলের পাহাড় হামলে পড়েছে ওদের ওপর। আশেপাশে থাকা সতীর্থদের তৎপরতায় এ যাত্রায় ওরা বেঁচে গিয়েছে। সাহসী যে ভাগ্যদেবী তারই তো সহায় হয়! কী ঠিক কিনা!
আমি সম্পাদক হলে পরবর্তী ঝড় কভার করতেও ওই মেয়েটিকে পাঠাতাম। কী যেন নাম দেওয়া হয়েছে পরের ঝড়ের? ও হ্যাঁ, ‘গুলাব’। এবার যশ বাড়ল মেয়েটির, পরের বার নাকে আসবে গোলাপের সুঘ্রাণ। প্রশংসা করতে না পারুন বেচারিকে দোষারোপ করবেন না।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

