- August 13th, 2022
মফস্বলের ভাইরা
নিরানন্দর জার্নাল (১৩)
মফস্বলের ভাইরা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
সহোদর অঞ্জনকে নিয়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় কলম ধরেছেন। দুঃসাহসী কাজ, ভাইয়ের চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরের শোক-বিহ্বল মুহূর্তে তার স্মৃতিচারণ করা সহজ কথা নয়। দুর্ভাগ্যের কথা এমন একটি কাগজে আলাপনের মুক্তো দিয়ে গাঁথা লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে যার প্রচার সংখ্যা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। হতে পারে, অন্য কেউ হয়তো ওর কাছে লেখা চায়নি।
আলাপনের লেখার উৎকর্ষ নিয়ে মন্তব্য করা বাতুলতা। আমাদের প্রজন্মে ওর মতো ঋজু, সাবলীল, লিরিকাল বাংলা গদ্য কেউ লিখতে পারেনি, তরুণতর প্রজন্মেও এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। সেই ১৯৮৩ সাল থেকে আমি ওর লেখার মুগ্ধ পাঠক, কিছুকাল আগে ওর ‘আমলার মন’ বইটি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। এই সময় কাগজে বইটির সমালোচনা করতে বসে আমি খুঁত ধরার মতো কিছু খুঁজেই পাইনি। আমার এই ব্লগ-সাইটে বইটির পর্যালোচনা আছে, উৎসাহী কেউ চাইলে সেটি পড়ে দেখতে পারেন।
আলাপন-অঞ্জন দুই ভাই, এই তথ্যটি ওদের পরিচিত বলয়ের বাইরে তেমন ভাবে চাউড়ই হয়নি কোনও দিন। আমিও দুই ভাইকে পরস্পরের কথা বলতে শুনেছি কদাচিৎ। অঞ্জন দাদাকে অনুগমন করেছিল শ্রীরামচন্দ্রের পিছনে থাকা লক্ষণের মতো। কোলিয়ারি থেকে নরেন্দ্রপুর, সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলজে-হিন্দু হস্টেল, কলেজে থাকতে প্রেম, সবশেষে সাংবাদিকতা দুই ভাইয়ের জীবনরেখা এ পর্যন্ত হুবহু এক। আলাপন সাংবাদিতায় অল্প দিনের মধ্যে সুনাম অর্জনের পরে চলে গেল আইএএস হতে। এখানেই প্রথম দুই ভাইয়ের পথ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জন যেমন নিজে আমলা হওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি তেমনি দাদার আলোয় নিজেকে আলোকিত করার চিন্তাও মাথাতে আনেনি। নিজের শিক্ষা ও তজ্জনিত আত্মপ্রত্যয়কে পাথেয় করে অঞ্জন নিজের স্বতন্ত্র সত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, পেরেওছিল।’ আমি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই’ এ কথা ভেবে মনে মনে অঞ্জন নিশ্চয়ই গর্বিত ছিল, প্রকাশ্যে বলার মতো হীনমন্যতাবোধে ও কখনও পীড়িত হয়নি।
আজকের লেখাটিতে আলাপন কেবল ভাইকে নিয়ে লেখেনি, ওদের গোটা পরিবারের প্রেক্ষাপটে মফস্বলি দুই ভাইয়ের আগু-পিছু পথ চলার নির্মোহ ছবি এঁকেছে। আলাপন বারেবারে লিখেছে এই কলকাতা শহর ওদের বাবার প্রতি সুবিচার করেনি, যদিও অবিচারের ধরন-ধারণ নিয়ে সে একটি শব্দও খরচ করেনি। লেখাটি পড়লে মনে হয় যেন পিতার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়াটাই ওদের দুই ভাইয়ের অঘোষিত প্রতিজ্ঞা ছিল, ওরা যে যার মতো করে তা রক্ষা করেছে। বটেই তো, এক ভাই হয়েছে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, অন্যজন জনপ্রিয় সাংবাদিক। কলকাতা বশ মানতে বাধ্য হয়েছে বন্দ্যোপাধ্যায় ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছে।
সদ্য চলে যাওয়া প্রাণের সহোদরকে নিয়ে লিখছে অথচ আলাপনের লেখায় বাঙালি-সুলভ আবেগের লেশমাত্র নেই, বিষয় যদিও সবচেয়ে কাছের মানুষজন তবু সচেতন দূরত্ব তৈরি করে দেখা। ভিজে চোখে আলাপন এ লেখা লেখেনি, লেখাটি পড়ে পাঠকেরও চোখ ভিজে ওঠার কথা নয়। বিশেষণ, অশ্রুজল বর্জিত এই লেখা আমার বহুকাল মনে থাকবে লেখকের পরিমিতিবোধের জন্য। তোকে কুর্নিশ, আলাপন।
লেখার অন্তভাগে এসে জানা গেল অঞ্জন চ্যানেলের কাজে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। ‘ছোট ভাই টিকা নেয় না, চ্যানেলের রাজদণ্ড নিয়ে মাঠে অযুতের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে নেমে যায়। ট্রেনের ভিড়ে যাতায়াত করে ভোটের বাজারে। হায়, বিজয়ের কেতন কি অমন জীবনপন তুলতে আছে? ভাই রণক্ষেত্র থেকে চলে যায়। জীবনের প্রতিটি দৃশ্যে সে দাদার থেকে একটু পরে প্রবেশ করত, একটু যেন দাদাকে আড়াল করে, আরও একটু নায়কোচিত ভঙ্গিমায়। সেই অজেয় ব্যুহকৌশল ত্যাগ করে সে হঠাৎ এগিয়ে গেল কেন?’
প্রশ্নের উত্তরও আলাপন নিজেই দিয়েছে। ‘মফস্বলের ভাইদের যুদ্ধনীতিতে, জীবনচর্যায়, নগরবিজয়ে এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। বড় ভাই ভাবে, আর অবশেষে বোঝে যে, সংরাগে ও বিদ্রোহে, দুষ্টুমিতে ও পরাক্রমে, ছোটো অনেক বেশি আগুন খেকো ছিল। সেই আগুন ওকে খেল কিন্তু সে-ও তো আগুনকে খেতে চেয়েছিল।’
হক কথা লিখেছিস আলাপন। পেটের মধ্যে আগুন বড় সর্বনাশা। আবার সেই আগুনটা ছিল বলেই না ও অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

