- August 13th, 2022
একদিন যদি খেলা থেমে যায়
একদিন ঠিক স্থির হবে
কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
রাত্রিশেষে ভোরের জানলায় রোজ যখন নতুন একটা দিনের প্রথম আলো এসে পড়ে, একটু দূরেই যখন অপেক্ষায় থাকে নরম রোদ্দুরেরা, পাশের কৃষ্ণচূড়ার পাতা যখন দিনের প্রথম মোহবাতাসে দোলে, শেষ অন্ধকারের শুকতারাটি ভোরআকাশে যখন অস্তিত্ব জানান দেয়, তখন মনে হয় সব তো তেমনই আছে। যেমন ছিল একদিন একই উত্তরপুরুষে, একই জ্যোতির্বলয়ে, একই মহাজাগতিক ছায়াপথে। ছন্নছাড়া গলিপথগুলো মোড় থেকে চৌকাঠে এখনও তো আসছে নিয়মমতো, নিস্তরঙ্গ নদীর শান্ত চিকণ জল এখনও তো বইছে তেমনই। পাহাড় অরণ্যের একাকীত্বের দীর্ঘশ্বাস যেমন ছিল তেমনই তো আছে আশ্রিতসুখে। মেঘ রোদ্দুর নিয়ে আকাশের দিকশূন্য নীল ওই তো মাটিতে নেমেছে আগের মতো। তবে কেন এত গভীর নিস্তব্ধ অবসাদ পারাবার জুড়ে। সারি সারি শোকের এত অসীম নির্মমতা, এত অমর্ষতা কেন? রাতগুলো এখন এত দীর্ঘায়িত কেন? যেন কৃষ্ণগহ্বরের চাদরে মোড়া। নিদারুণ এক স্পর্ধিত ব্যাধির হাহাকারে এত অসীম ঔদ্ধত্য কেন? মাটিরং বিষাদ ঘূণপোকার মতো কোন অভিশাপের সর্বনাশী ছায়া ফেলছে আজ চরাচর জুড়ে? সমস্ত সৃষ্টি যেন ভেসে যাচ্ছে অতলবাসে। ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নেবার কী আকুল আর্তি পৃথিবীর। বাতাসে মানুষ পোড়ার গন্ধ এত প্রকট কেন? হাজার হাজার চিতার আগুনের অসহ্য আঁচ আমাদের গায়ে এসে লাগছে সকাল সন্ধে, কেন? কোন পাপে? কার পাপে?
আসলে পৃথিবী ভালো নেই। বিষময় চতুর্দিক। সে আজ দগ্ধ, অভিতপ্ত, রক্তাক্ত, ক্ষয়িত। ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তমসাবৃত তার আত্মা। যেন এক দুর্বহ দাহনভার বইছে ক্রমাগত। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর। তার এই দুর্বার ক্রোধ, এই আক্রোশ, এই শোণিত ক্ষয় হয়তো আমাদের জন্যই। এই পাপ হয়তো আমাদেরই। তাই বহনও আমরাই করছি। এর দায়ভারও আমাদেরই। আজ তার ফেরাবার দিন। এই অত্যয় অসময় আজকের নয়। হাজার বছর ধরে সমস্ত সৃষ্টির সমস্ত আদিমতার সমস্ত অস্তিত্বের গায়ে দাগ দিয়েছি এতদিন আমরাই। এখন সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রবল ঝড়ের মতো। বিরক্ত। ক্রুদ্ধ। এসেছে মারণের শর নিয়ে। বিনাশ আর ক্ষয় নিয়ে। হয়তো এটাই আমাদের প্রাপ্য ছিল।
জানি না, শুধু জানি, সারাদিন কৃষ্ণপক্ষের রাতের মতো নিঝুম শীতল ভিনদেশি এক মরণস্পর্শ এখন যেন আমাদের শরীর জুড়ে থাকে। এবার কার পালা? এরপর কে? অতলান্ত ভয় পায়ে পায়ে। আমাদের প্রতিটা অণুপরমাণুতে। প্রতিটা রক্তকণিকায়। হয়তো ওরা অহেতুক কিন্তু মিথ্যে নয়। ওরা অনুগত কিন্তু স্পষ্ট নয়। আমরা এখন আনখশির এই বিষাক্ত ভয়ের অধীনে। পরাজিত। বিভ্রান্ত। নির্জিত। বিপর্যস্ত।
সেই কবে থেকে রয়ে যাওয়া ঘরের প্রতিটি কোণায় স্থির বিশ্বাসগুলোর এখন জায়গা বদল হয়েছে। দেওয়াল জুড়ে এখন বাস করে শুধু শোকের মিছিল। কিছু স্বর কিছু ধ্বনি, কিছু সুর জানলার পাশে রাখা ছিল, দরজা জুড়ে পড়েছিল কিছুটা দম্ভী বাতাস, কখনওবা জ্যোৎস্নার কিছু চাঁদরেণু। কড়িবরগা দিয়ে চুঁইয়ে নামত শান্ত কিছু শীতলতা। এখন ওরা কোথায়? কোন জন্মের পারাপারে চলে গেলো? একেবারেই কি গেলো সব মায়ার বাঁধন ছেড়ে, ছিঁড়ে? আরও গভীরে?
জানি একদিন সে স্থির হবে, শান্ত হবে, স্থিমিত হবে। একদিন ঝড় থেমে যাবে। মৃত্যুর মিছিলে টান ধরবে। একদিন সে আবার ছন্দে ফিরবে। জীবনে ফিরবে। একদিন সে নতজানু হবে আজন্ম পিপাসায় আবার। কিন্তু সে ফেরা কি ফেরা হবে? নতুন করে সবটা গড়া সহজ নয়। যারা রয়ে যাব একটা নতুন পৃথিবী পাব। হয়তো অশক্ত, জীর্ণ, অসুস্থ এক পৃথিবী। তারপরই তো শুরু হবে দেনা-পাওনার নতুন হিসেব, পড়ে থাকা জীবনের সঙ্গে। কার কী গেলো, কতোটা গেলো, কে কতটা দীন হলাম বোঝাপড়া সেইদিন হবে। দৈন্যভারে জীর্ণ জীবনের সঙ্গে ভুল ঠিকানায় গোল্লাছুট তখন শুরু হবে। আঁচড় যা পড়ল হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে তা কতটা গভীর সেইদিন বুঝবো। খণ্ডিত দিশায় কার কতটা আরও হাঁটতে হবে সেইদিন জানবো। রক্তলাল ক্ষতটুকুর দাগ মেলাতে কতখানি কষ্ট সেইদিন বুঝবো। এমন নিশ্চল অস্থির কিছু দীর্ঘ বোধ তাড়া করবে বাকি জীবনটুকু। সকলের। কারও কম, কারও বেশি। শোক অতিক্রম করে কেউ কেউ জীবনের কাছে ফিরব শূন্যহাতে, রিক্ত, নি:স্ব হয়ে, শিকড়হীন হয়ে আর সীমাহীন দাসত্ব নিয়ে। ছেঁড়া ফুটিফাটা সেই আধপোড়া জীবনের কাছেই। ওখানেই তো পড়ে আছে শেষ শ্বাসটুকু আত্মার জনেদের কাছে। প্রাক্তন স্বপ্নগুলোর কাছে। ওদের ছেড়ে যাব কোথায়? কেনইবা যাব? আত্মিক শেষ স্পর্শটুকু ঘাসজমির শিশিরবিন্দুতে রেখে যেতে হবে। দায় দায়িত্ব তো থেকেই যায় সাত হাত মাটির নীচে, মরণের এপারে আরও কিছু দেবার নেবার লোভ সেটুকুও তো থেকে যায় অনেকখানি ইচ্ছেসুখ নিয়ে...


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

