- August 13th, 2022
একদিন যদি খেলা থেমে যায়
তিন অঙ্কে একই খেলা
উজ্জ্বল সিনহা
এক
ক্লাস সিক্সের পড়া শেষ। এ বার এই মফস্সল ছেড়ে কলকাতা চলে যাব এ খবরটা সবার মধ্যে একটু তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেল বোধ হয়। সন্ধ্যায় মাঠ থেকে খেলা শেষে ফিরছি, সে এসে বলল একবার কাল সকালে আসিস, কালোদিঘির পাড়ে, আমার দরকার আছে। তাকে দেখলেই আমার ধমনিতে বান ডাকে, সে বললে আমি হাসতে হাসতে জাহান্নাম যেতে রাজি, কালোদিঘি আর কোন ছার। ঠিক নটার সময় আসবি কিন্তু… যেতে যেতে শেষ কথা বলে গেল সে। অবশ্য দেখা হলে শেষ কথা তো সেই বলে প্রতিবার।
মিনিট কয়েক হল এসেছি, বুক দুরদুর করছে, বাড়িতে মিথ্যা বলে এসেছি তাই। হঠাৎ দেখি দূর থেকে সে আসছে। আমাকে দেখে থমকাল এক লহমার জন্য তারপর উল্টোদিক ফিরে হাঁটা দিল আবার। অগত্যা আমিও। দমকা হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে তার ফ্রক, মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে শরীরের বিভঙ্গ। শুঁড়িপথের দু’ধারে অযত্নে বেড়ে ওঠা আকন্দ, বনতুলসীর ঝোপ আর হেলেঞ্চা শাকের পাশ থেকে উঁকি মারছে সারি সারি লজ্জাবতী লতা। তার দু’হাত প্রসারিত দুধারে, ছুঁয়ে যাছে সেই সব লতা গুল্মদের। পোষ মানানো প্রাণীর মতো আদরে নুয়ে পড়ছে তারা। একটু পরে শুনতে পেলাম গান গাইছে সে। রিনরিনে সেই শব্দ সব ভেসে যাচ্ছে হঠাৎ আসা হাওয়ায়। ওলট পালট হয়ে ফিরে এসে ধাক্কা মারছে আমার মরমে। “একদিন যদি খেলা থেমে যায় …” জোরে পা চালাচ্ছি আমি, তার পাশে পাশে হাঁটব বলে। কানে ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কলি… “তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।” আমি কি ভুল শুনলাম? আসলে পঙক্তিটা কি? যদি দূরে যাও চলে? অস্ফুট স্বরে বলার চেষ্টা করছি, “দূরে তো নয়, কলকাতা তো কাছেই”। কাছে এসে গেছি এ বার, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে এমন সময় ছুট মারল সে। “তোর সঙ্গে আর কথা কবো না আমি”। ছুট ছুট ছুট, সোজা গিয়ে থমকাল যেন এক মুহূর্ত আর তারপর ডুবঝাঁপ। ঝুপুস। স্থাণুবৎ আমি, দাঁড়িয়ে আছি। শ্রাবণের ধারা আমার দু’চোখে। আমি জানি ও সাঁতারে ভালো, স্কুলের চ্যাম্পিয়ন।
দুই
জে এফ কে এয়ারপোর্টে প্লেনের চাকা মাটি ছুঁল তখন ঘড়িতে ইস্টার্ন সিবোর্ড সময় সকাল দশটা বেজে কুড়ি মিনিট। এমিরেটস-এর সুন্দরী ঘোষণা করছেন আমরা নির্ধারিত সময়ের পঞ্চাশ মিনিট আগেই এসে পৌঁছেছি অভীপ্স গন্তব্যে। মন গহিনে হঠাৎ প্রশ্নের বুড়বুড়ি কাটছে যেন; নির্ধারিত সময় মানে কি? কে নির্ধারণ করে আমাদের সময়? কে জানায় ভিতর থেকে আর নাইরে বেলা নামল ছায়া ধরণিতে? আজকাল প্রায়ই হচ্ছে এর’ম, বয়েস হয়ে যাবার লক্ষণ নির্ঘাত। যাকগে, আমার সামনে এখনও অনেকটা যাত্রা বাকি, প্রায় পাঁচ ঘণ্টার গাড়ি সফর তাই এসব দার্শনিক চিন্তায় মন না দিয়ে বরং শনকে একটা ফোন করি। নাকি, থাক, ইমিগ্রেশনের পর করাই ভালো। কে জানে কত লম্বা লাইন পরেছে। শন মানে যার নাম আমাকে বোস্টন কার সার্ভিস পাঠিয়েছে, আজকের জন্য সে আমার সারথি। প্লেন নামার আগেই আমি প্রাতঃরাশ সেরে নিয়েছি, এখন শনকে খুঁজে পেলেই সোজা পাড়ি দেব ইথাকা'র দিকে।
আজ ভাগ্যবিধাতা সত্যিই সদয় আমার ওপর। এয়ারপোর্টের অভিবাসন এলাকা একদম ফাঁকা, মিনিট দশেকের মধ্যে আমি লাইনের একদম সামনে। অফিসার পল একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কতদিন থাকবেন? কোথায় থাকবেন আর কি কাজে এসেছেন এ দেশে?” জানালাম নিউ ইয়র্ক রাজ্যেই থাকব, তবে শহর থেকে অনেক দূরে, ইথাকা যাব। দিন তিনেকের জন্য, সেখানে পারিবারিক কিছু কাজ আছে। পাসপোর্টে ছাপ মেরে ফেরত দেবার সময় আবার হাসলেন তিনি। “ভালো ভালো। পুত্র নাকি কন্যা? কে পড়ে সেখানে? আমার অভিনন্দন জানাবেন তাকে”। “নেক্সট”- পল এবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এক মেক্সিকান পরিবারকে নিয়ে। এ বার শনকে ফোন করার পালা। দু’বার রিং হতে না হতেই "হ্যালো, শন স্পিকিং, হাউ মে আই হেল্প?” আরে চেনা গলা যেন, বড্ড চেনা উচ্চারণ ঠাওরাচ্ছে যে? যাইহোক, বাইরে এসে নম্বর মিলিয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে দেখি মধ্যবয়স্ক সারথি দাঁড়িয়ে আছেন দরজা খুলে। নির্ভেজাল বঙ্গপুঙ্গব, ১০০ ফুট দূর থেকে দেখলেও ঠিক চিনে নেওয়া যাবে! একটা চান্স নিলাম… ‘আপনি বাঙালি তো? তাহলে, শন?’ ‘শাওন, আমার নাম সাদ্দাত হোসেন শাওন। এখানে কেউ শাওন উচ্চারণ করতে পারে না, বা কষ্ট করে বলতে চায় না হয়তো, তাই নামটা শন হয়ে গেছে।’
ফ্লাশিং মেডো পার হয়ে শাওন জিজ্ঞাসা করল, একটু কুণ্ঠিত স্বরে। “বাংলা গান শোনেন আপনি? একটু বাজালে অসুবিধা হবে না তো?” “আমার আবার কী অসুবিধা, কিন্তু অন্যান্য সময় কী করেন? আপনার যাত্রীরা রাজি হন বাংলায় গান শুনতে?” শাওনের চোখ নেমে আসে স্টিয়ারিঙের ওপর। “না না, আমার প্রায় সব যাত্রী এদেশের, প্রশ্নই ওঠে না। গাড়িতে একলা থাকলে শুনি।” আমার চোখে সম্মতি দেখে স্টিরিওর বোতাম টেপে সে। ‘যদি একদিন খেলা থেমে যায় মধুরাতে, তবু মনে রেখো। একদিন যদি বাধা পড়ে কাজে …’ রাজ্যেশ্বরী দত্ত গাইছেন আমার প্রাণের গান আর আমি একটু একটু করে ফিরে যাচ্ছি শৈশবে। হুঁশ ফিরল শাওনের কথায়। “মাঝে মাঝে কাঁদতে পারলে ভালো কর্তা… বিষাদ থাকবে না মনে।"
তিন
ঘুম ভাঙল একটা অচেনা অনুভূতিতে। একটু যেন অন্যরকম লাগছে ভেতরটা। সবকিছু কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতরে। একটু ঠাওর করে ভাবার চেষ্টা করলাম আমি কোথায়? আজকাল কাজে অকাজে এত বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাই মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়, রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে, ধাতস্থ হতে দু'এক মুহূর্ত লাগে। আজও কি তাই? ঘরে চোখ সওয়া অন্ধকার, মিহি শব্দে বাতানুকূল যন্ত্র জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি নিজের ঘরেই আছি কিন্তু কিছু একটা যেন মেলাতে পারছি না। বাঁদিকের টেবিলে নীরব, উল্টে রাখা ফোন হাতে তুলতে গেলাম, যদি সময়টা দেখা যায়। বুকের বাঁদিকের যন্ত্রণা এখন বাহুমূল থেকে পিঠের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। একটু জল খেলে কি ভালো লাগবে? সব কিছু এলোমেলো লাগছে, মাথাটা পরিষ্কার নয় কেন? এ মত, নানা জাগতিক, তুচ্ছ আর অদরকারি, খুঁটিনাটির জঞ্জালের মধ্যে হঠাৎ শুনলাম বুকের গভীরে, দূরে, বহু দূরের কোনও রেডিও স্টেশনে গান বাজছে। রাজ্যেশ্বরী দত্ত শুধুমাত্র আমার জন্য গাইছেন, “যদি একদিন খেলা থেমে যায় মধুরাতে”। সবকিছু এখন পরিষ্কার। কালদিঘির ধারে এসে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আজ ডুবঝাঁপ দেবো, এখনই। ঝুপুস।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

