- August 13th, 2022
একদিন যদি খেলা থেমে যায়
থামতে হবেই তাই তো খেলাটা অমূল্য
সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী দাশগুপ্ত
আমার ছেলেবেলার আবহে ‘খেলা’ প্রায় নিষিদ্ধ শব্দ ছিল, বড়কাকুদাদুর সৌজন্যে। বড়কাকুদাদু, আমার বাবার অকৃতদার বড়কাকা। বাংলা সিনেমার বাইরে আমার দেখা প্রথম পেট্রিয়ার্ক। আমাদের একান্নবর্তী গেরস্থালিতে সমস্ত বস্তুবাদী ও ভাববাদী সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনিই ছিলেন একমাত্র এবং শেষ কথা। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো বাড়ির লাগোয়া গুলঞ্চ গাছটাও বুঝি ফুল ফোটানোর আগে বড়কাকুদাদুর অনুমতি নিয়ে নেয়। যা কিছু অপ্রয়োজনের, যাতে আত্মার আনন্দ, প্রাণের আরাম ছাড়া অন্য কোনও প্রাপ্তি নেই, সবটুকুই অর্থহীন খেলা ছিল তাঁর কাছে। তাচ্ছিল্যের, হেলাফেলার। ছোটকার আড্ডা, বাবার পরোপকারের বাতিক, ফুলপিসির প্রেম, সন্ধে পেরিয়ে দাদাভাইয়ের লুটোপুটি ফুটবল খেলা, লোডশেডিংয়ের রাতে ছাদে অন্ত্যাক্ষরির আসর, সব কিছুতেই তাঁর ক্রুদ্ধ, বিতৃষ্ণ প্রতিক্রিয়াটি ছিল, ‘কাজে নেই, কম্মে নেই, ধেই ধেই করে খেলে বেড়াচ্ছে সারাদিন!’
আমার অক্ষরজ্ঞান, আমার যেটুকু কেতাবি বিদ্যে, সবটুকুই বড়কাকুদাদুর কাছে। বড্ড ভালোবাসতেন আমাকে, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নীতিবাগীশ করে তুলতে চেয়েছিলেন, নিজের আদর্শে। এদিকে, যে কোনও নিষিদ্ধ জিনিসের মতো, খেলার প্রতি আমার তীব্র টান, ছেলেবেলা থেকে। কাজ আর খেলার এই দ্বৈরথে, হোঁচট খেতে খেতে, পড়ে যেতে যেতে, ধুলোবালি মেখে আবারও উঠে দাঁড়িয়ে দিব্যি কেটে যায় দিনরাতগুলো।
খেলা, সে প্রেম হোক বা বৈরিতা, দু’জনের বা দু’দলের, প্রাণখোলা আনন্দ কিম্বা দাঁত-চাপা প্রতিযোগিতা, তার সবটুকু রহস্য লুকিয়ে থাকে তার অনিশ্চয়তার ভেতর। খেলা শুরু আর খেলা থেমে যাওয়ার মধ্যে হয়তো বা ধরা থাকে একটা গোটা জীবনের বিভ্রম। মধুরাতে যে খেলা থেমে যেতে পারে, সে তো আমার বড়কাকুদাদুর ভ্রুকুটি-বিড়ম্বিত ‘খেলা’ নয়, নয় বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় নেশাতুর লম্পটের প্রগলভ ‘খেলা’ও। জীবনকে সঙ্গে নিয়ে কিম্বা জীবনকে বাজি রেখে যে খেলায় নামতে হয়, এ সেই খেলা। তার মাঝখানে ওই ভীরু, দ্বিধাগ্রস্ত ‘যদি’-টিকে ধুরন্ধর কবিমশাই নিছক খেলার অনিশ্চয়তার সূচক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেবেন, মানতে মন চায় না। যে খেলা শুরু হয়েছে, তা থামবেই, এ অনিবার্য, কোনো, যদি-তবে-কিন্তুর অবকাশ নেই তাতে। ‘থেমে’ যাওয়াটা অমোঘ বলেই না খেলাটা অমন অমূল্য! তবে খেলাটি ফুরোলো, না তাকে অসম্পূর্ণ রেখেই কোনও মধুরাত, নিঃসঙ্গ দুপুর কিম্বা চন্দ্রালোকপ্লাবিত সন্ধ্যায় খেলার অঙ্গনটি ছেড়ে চলে যেতে হলো, এটুকুতেই যত অনিশ্চয়তা। সে অনিশ্চয় অশ্রুবিন্দুর মতো টলটল করছে ওই ‘যদি’ শব্দে।
জীবন বড় আজব কারখানা। যে বন্ধুর কাছে হেরেই সুখ, তার কাছে জিতিয়ে দেয়। যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে না-হারালে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারব না জীবনভর, তার কাছে গো-হারান হারিয়ে হা হা হাততালি দেয় সে পাগল। মোহ আর অহং-এর ছদ্ম নির্মোক খসে পড়ে একে একে। এক খেলা শেষ হতে না হতে নতুন খেলায় ডেকে নেয় জীবন, তার কাছে নত হওয়ার পাঠ দেয় হাতে ধরে।
তবু কোনও কোনও কালপর্ব আসে যখন সমস্ত শিক্ষা মিথ্যে হয়ে যায়। চেনা নিয়মকানুন ওলট-পালট হয়, খেলা না ফুরোতেই শেষের বাঁশি বাজান অদৃশ্য রেফারি, বিনা প্রস্তুতিতে দান ছেড়ে উঠে পড়তে হয় খেলুড়েকে, বিদায়কালে ‘যাই’-এর উত্তরে বৃদ্ধা পিতামহীর মত কাঁপাস্বরে বলা, ‘যাওন নাই, আসো গিয়া’ শোনার অবকাশটুকুও মেলে না। খাঁ খাঁ করা প্রান্তরে অযত্নে পড়ে থাকে ফেলে যাওয়া গুটি, একলা পুতুল! বিষাদের কণা চুঁইয়ে চুঁইয়ে জমা হয় খেলাঘরের আকাশ-বাতাস। বিচ্ছেদের ব্যথা, অনিশ্চয়তার চাপা আশঙ্কা আর শুকনো পাতা ঝরা ফুলের দস্তাঁন থমথমে করে রাখে খেলাঘরটিকে। ওই যে ‘যদি’-টাকে দুর্বল দ্বিধা ভেবে অবহেলা করেছি, সেটাই একমাত্র সত্যি হয়ে ওঠে জীবনে! খেলা থেমে যায় অসময়ে, রেখে যায় অপার শূন্যতা, হাড়-হিম অনিশ্চয়তা। কাল থাকবে তো সবকিছু, যা ঘিরে আছে আজ? ঠিক এ ভাবেই থাকবে তো? বাস্তবে থামুক না থামুক, এই শীতল আতঙ্কই তো আসলে আরেক নাম, খেলা থেমে যাওয়ার!
যতই না কেন কাষ্ঠহাসি হেসে নিজেকে পার্ট অফ হিস্ট্রি ভাবি আর পিঠ চাপড়াই নিজেরই, আসলে তো মহাকালের মোহনায় দাঁড়িয়ে থাকা সে ভয়ঙ্করের কাছে একটা অ্যামিবা কিম্বা কাঠপিঁপড়ে বৈ কিচ্ছু নই আমি। আমাদের থোড়-বড়ির যাপনকে তছনছ করে, হেঁটমুণ্ডু ঊর্ধ্বপদ ঝুলিয়ে, হারুণ-অল-রশিদের মতো লোফালুফি খেলে, খেলা ভাঙার এ খেলায় মেতেছেন যিনি, মাঝেমাঝে তাঁকে এক উদাস-অহঙ্কারী রাজা বলে মনে হয় আমার। শিরদাঁড়া নুইয়ে জোড়হাত মেনে-নেওয়া অথবা এড়িয়ে যাওয়ার ধূর্তামি নয়, চোখে-চোখ রেখে খানিক লড়ে নেওয়া আর দাঁতে-দাঁত চেপে বাকিটুকু মানিয়ে নেওয়া প্রতিপক্ষই তাঁর উপযুক্ত, তেমনটাই তিনি প্রত্যাশাও করেন নিশ্চিত।
ভেঙে পড়তে পড়তেও তবু মায়াজল টলটল করে বুকের ভেতর। খেলা থেমে যাওয়ার এ বিপজ্জনক খেলা ঘিরে ধরে বলেই আরও তীব্র সংরাগে জীবনকে জড়িয়ে নিতে মন চায়। মানুষের নির্ভেজাল বজ্জাতির তুঙ্গ দেখা হলো, দেখা হলো তার অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতা, পাশাপাশি নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া মানুষও যে কত দেখলাম, তাই বা কম কী! অতি-ইচ্ছার ডানা ছেঁটে সময়ের মাপমতো করে নেওয়া যে আমি-র সঙ্গে আলাপ হলো, সেও তো প্রত্যাশার অতীত! অর্থহীন কোলাহল পেরিয়ে সময় হলো, গহন নীরবতার। তীব্র হননেচ্ছা আর খুচরো প্রতিশোধ যা বাকি রইল, শুধু সেটুকুর জন্যও তো নতুন খেলা শুরুর প্রতীক্ষা করা যায়! মানুষই তো একমাত্র প্রজাতি যে ঘৃণায় জর্জরিত হয়েও অবচেতনেও শত্রুর মৃত্যু নয়, পরাজয়ই চায়। চকিতে খেলা থেমে যাওয়ার এই অভিশপ্ত নিও-নর্মাল নয়, জমাটি খেলার শেষে সে জিততে চায়, কখনও কখনও হারতেও।
আর সব্বার ওপর, সেই সব ছায়াময় গাছ, নাছোড় হাত, টলটলে চোখ, দূরভাষের তরঙ্গে আছড়ে পড়া কুশল জিজ্ঞাসারা তো আছেই, তারাই তো খেলা থেমে যাওয়ার বেদনার বুকে নতুন খেলা শুরুর মায়াবী অপেক্ষা! তবে, এসো, খেলা! চোখে চোখ রেখে দেখে নিই তোমায়! মধুরাতের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে!


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

