- August 13th, 2022
একদিন যদি খেলা থেমে যায়
খেলারাম খেলে না
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
কলকাতা দেখতে এসেছেন তো আসুন, দুটো প্রত্নস্হলে নিয়ে যাই। দুটোই মহাতীর্থ। হেরিটেজ কমিটি অফ কলকাতা এদের আকৃতি পরিবর্তন করতে দিচ্ছে না। খেলা শেষ হবার আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে।
প্রথমে যেখানে এলেন, দেখুন লোহার গেট, উপরে টিনের চালা, ভিতরে দেখুন সার সার বেঞ্চি, হাই বেঞ্চ, লো বেঞ্চ, ঠিক যেন ইস্কুল। আদর আর শ্রদ্ধা মেশানো একটা ডাক নাম আছে এর। কেটি। কেটি মানে খালাসিটোলা। কেটি আর বিডি দুই ভাই। যেন জগন্নাথ-বলরাম। কিংবা ধরুন ভানু-জহর। খুঁটি বাঁধা জুটি। দুই মহাতীর্থ। গয়া-কাশী। রাগ করলেন? আচ্ছা, মক্কা-মদিনা।
এই যে ফুটপাথটা, এখানে সাজ্জাদ এখন তুলসি পাতা বিক্রি করছে। ও আগে খাসির বট বিক্রি করতো। বট মানে বুঝলেন না? সোজা কথা নাড়িভুড়ি। বেশ লঙ্কা-রসুন দেওয়া, লাল লাল মাখা মাখা। সস্তার চাট। ভজহরি বিক্রি করছে বেল ফুল। ভজহরি আগে তেলেভাজা বিক্রি করতো। ডালবড়া, বেগুনি, পেঁয়াজি ছাড়াও বেসনে ডোবানো চিংড়ির বড়া। চিংড়ির ল্যাজটা বেরিয়ে থাকতো যেন ল্যাজ উঁচিয়ে বলতো দেখো, আমিই সেই।
ভেতরে ওই যে সার সার বেঞ্চি, এখন ওখানে আর ছারপোকা নেই। তখন ছিল, কমলকুমার মজুমদার যোগব্রত চক্রবর্তীকে বলছেন ওদের খেতে দে, ছাড়, ছাড়, ছেড়ে দে। ছেড়ে দিতে হয় বলেই ছারপোকা নাম। আমার শীর্ণ পশ্চাৎপ্রান্তে শোনিত প্রবাহ বেশ ক্ষীণ। রক্ত বেশি পাবে না। আসতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত চক্রবর্তী, ঋত্বিক ঘটক, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এই রূপহীন অরূপে। এখানে বাংলা মদ বিক্রি হত। একটা মজার কথা বলি, একবার বাংলাদেশ থেকে কিছু কবি এসেছিলেন সাহিত্য অকাদেমির আমন্ত্রণে। ওরা এই তীর্থস্থানটি দেখতে চেয়েছিলেন। বছর কুড়ি আগেকার কথা। আমি নিয়ে এসেছিলাম এই কবিকূলকে। সবাই মিলে বাংলা মদ সেবন করা হয়েছিল। বাংলাদেশে মদের খেলা নিষিদ্ধ। ওরা এ খেলা ওখানে খেলতে পারে না। ওরা কেউ আল মাহমুদ, কেউ মহাদেব সাহা, কেউ হেলাল হাফিজের কবিতার লাইন বলছিল। শক্তিরও। ওদের একজন বেঞ্চির ওপর দাঁড়িয়ে বলেছিল হামিন অস্ত, হামিন অস্ত। এখানেই জান্নাত। এখানেই স্বর্গ। যখন উঠবো, সবাই পকেট থেকে টাকা বের করছিল। আমি বলেছিলাম আপনারা কেন, আপনারা আমার অতিথি। আড়াইশো টাকা তো হয়েছে। ওদের একজন বলেছিল— ওকে, ওকে, আড়াইশো রুপি পার হেড? সমস্যা নাই। আমি বলেছিলাম— পার হেড নয়। মোট আড়াইশো। তেত্রিশ টাকা করে বোতল। পাঁচ বোতল একশো পয়ষট্টি, পাঁচ বোতল মিনারেল ওয়াটার পঞ্চাশ। বাতাবি লেবু, আলুকাবলি, ছোলা সেদ্ধ আর পেঁয়াজি বাকিটা। ওই তরুণ দলের যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনি প্রাজ্ঞও বটে। বললেন— এবার বুঝলাম জ্যোতি বসুরা কি করে এতদিন ক্ষমতায় আছেন। উনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন গরীবেরও মদিরায় অধিকার আছে। সাতজন মানুষের সমবেত সুখ মাত্র আড়াইশো টাকায় দিয়া দিছেন। আমরা কল্পনা করতে পারি না।
দেখুন, সেই বেঞ্চি রয়েছে। সেই কাউন্টারও। নানা ধরনের শরবৎ বিক্রি হচ্ছে। লেবুর, বেলের, দইয়ের, ওই দেখুন, উনি কী পান করছেন। গ্লাসের উপর ভাসছে তুলসি পাতা। বাইরে তুলসি পাতা বিক্রি হচ্ছিল, লক্ষ্য করেছিলেন নিশ্চয়ই, আদার শরবতের উপর তুলসিপত্র ভাসিয়ে পান করছেন। ইনি আবার চিনির শরবতে বেলফুল আর যুঁইফুল ভাসিয়েছেন। গোলাপের পাপড়ি ভাসানো দইয়ের ঘোলও পাওয়া যাচ্ছে। এই কেটির বিখ্যাত পানীয় হল কেডি। এক গ্লাস কেডি দিন বললে ওরা বেলপাতার রসের শরবত দেবে। কেডির পুরো নাম কাম দমন। জানেন নিশ্চই ষড়রিপুর প্রথম রিপুটি বেলপাতার রসে জব্দ হয়। আয়ুর্বেদে আছে।
এবার চলুন বিডি যাই। বারদুয়ারি। এই সাদা রঙের দোতলা বাড়িটার বারোটা দরজা ছিল। দেখলেই বুঝবেন দরজাগুলোর উপর আর্চ আছে, এবং দরজাগুলোকে ইটির গাঁথনি তুলে বন্ধ করা হয়েছে। কিছুটা জানালা করে রাখা আছে। পর্তুগিজরা ল্যাটিন আমেরিকার দেশ থেকে এদেশে এনেছিল অ্যানানাস। যেহেতু এই ফলটায় প্রচুর রস, তাই বাঙালিরা নিজেদের মতো করে ফলটার নাম দিল আনারস।
এই বারোটা দরজাওয়ালা বাড়িটা যেহেতু দেশি মদের বার, ঠিক তেমনি করেই বাড়িটার নাম বারোদুয়ারী থেকে হয়ে গেল বারদোয়ারি। আদর করে বি.ডি.। দেখুন এখানেও বেলপাতা বিক্রি হচ্ছে, তুলসি। ফুলের মালাও। ওই দেখুন কপালে তিলক, গলায় তুলসি মালা, হরি হরি বলতে বলতে গাঁদা ফুল কিনছে। যার কাছ থেকে কিনছে, সে আগে আলুর পকোড়া আর লঙ্কার পকোড়া বানাতো। সঙ্গে দিত একটা জিভে জল টানা চাটনি। ফলও বিক্রি হচ্ছে। ফল অবশ্যি আগেও পাওয়া যেতো, কাটা ফল। পেয়ারা-পাকা পেঁপে-শশা-শাঁকালু-বিটনুন লঙ্কা গুঁড়োর ছিটে দিয়ে। এখন গোটা ফল বিক্রি হচ্ছে। পুজো দেওয়ার জন্য লোকে ফলটল নিয়ে যাচ্ছে। দেখুন, লোকটা একটু টলতে টলতে ঢুকছে। মুখে কিছু একটা বলছে, আগে যে কারণে টলতো, ঠিক সে কারণে টলছে না। রাধা ভাবে বিভোর হয়ে টলছে। আগে যারা বিড়বিড় করতে করতে ঢুকতো, ওরা কেউ বলতো বাপের বিয়ে দেখাবো, কেউ বলতো মায়ের দুধ খেয়েছি বে, কেউ বা দেখা হবে? কবে দেখা হবে…। এই যে লোকটা টলতে টলতে ঢুকছে সেও কিন্তু দেখার বাসনাই বলছে। রাধে গো মিলন দেখাও, মিলন দেখাও। এটা এখন রাধা কৃষ্ণর মন্দির। আগে তো এ বাড়ি মন্দিরই ছিল। বারো দরজার মন্দির। শরিকি ঝামেলায় সম্পত্তির মালিকানা বদল হয়েছে বহুবার। এখনকার মালিক আবার মন্দির বানিয়েছে।
ওই যে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। লরঝরে সিঁড়ি ছিল। এখন শ্বেত পাথরের। দোতলায় উঠেই নজর থাকতো উপরে। পাখা কোথায় ঘুরছে। পাখার তলায় সিটটা নিতে হত। কড়ি বরগার ছাত থেকে ঝুলতো হলুদ হলুদ বাল্ব। তখন ঝাড়বাতি। পায়ের তলায় লেবুরস-লঙ্কা গুঁড়ো মথিত শালপাতা, আর বাতাসে মদির গন্ধ। এখন খালি পায়ের তলায় ঠান্ডা পাথর, ধূপ-চন্দনের গন্ধ। ওই যে, সামনে সিংহাসন। রাধা কেমন কৃষ্ণের গলার খাঁজে নিজে মালাটা দিয়ে দিয়েছে। শ্যাম স্টিলের বিজ্ঞাপনে হামেশা কে লিয়ে স্ট্রং বলে বিরাট কোহলির খাঁজে যেমন রাধা। রাধার ঘাগরাটা বেশ বডি ফিটিং। বডি লাইন বেশ বোঝা যায়। কৃষ্ণ কি ফাটা জিনস পরতে পারে না? এই বই নিন, কুড়ি টাকা মাত্র। একজন গেরুয়া ঝোলা থেকে বাড়িয়েছে একটা বই।
মধুররসরসার্ণব। এক সময় এরকম বই বাড়াতো সায়ক। একটা নিন না, আমি বোম বিস্ফোরণ সমর্থন করি। উৎসর্গ অ্যাডলফ হিটলার।
একতলায় কীর্ত্তন হচ্ছে। বোধ হয় অষ্টপ্রহরই হয়। সামনে দানপাত্র আছে। কাচের বাক্স। ইচ্ছে হয় তো কিছু ফেলুন।
আর একটা তীর্থস্থানে যাবেন নাকি? কাছেই। শাকি। ওটা অবশ্য দেশি বার নয়। বিলিতি। এই দুটো আগে দেখালাম কারণ এখানেই আছে ভারততাত্মা। এখানে রিক্সাওয়ালা, মেথর, কেরানি, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, শিল্পী, কবি, দালাল, সবাই একসাথে। যাকে বলে বেঁধে বেঁধে থাকা। এখানেই সবারে হবে মিলিবারে আনত শিরে।
শাকিতে বার সিঙ্গার আছে। মহিলা। কিন্তু কেটি বিটিতেও গান ছিল। সেখানে যে যেমন খুশি গাইতো। সবাই রাজা। থাক গে। শাকি বারেই আমি প্রথম ঝিনচ্যাক বার সিঙ্গার দেখি, মেয়ে। এরকম আরও অনেক বারেই এই ব্যবস্থা ছিল। নিভু নিভু আলোর বার ছিল, আবার খোলা আকাশের তলায় বাগান-বাগান বার ছিল। আবার গ্রাম বাংলায় তাল গাছের তলায় বিকেলে ছিল তাড়ির ঠেক। তাড়ি এমন একটা তরল, যা বানাতে হয় না, প্রসেসিং দরকার হয় না। নিজে নিজেই হয়। সকালের রস বিকেলে তাড়ি হয়ে যায়। ভগবানের খেলা। ভগবানের খেলা না বলে বরং বলি ‘ইস্ট’-এর খেলা। বাতাসে ইস্ট থাকে। থুড়ি, থাকতো। সেই ইস্ট মিষ্ট রসকে গেঁজিয়ে দিত। ‘গেঁজিয়ে দিত’ শব্দটা ভালো লাগলো না, তাই না? ফার্মেন্ট করে দিত বলি বরং?
লালমাটির দেশের বাংলা নিজস্ব সম্পদ ছিল হাঁড়িয়া আর মহুল। ‘পুরুল্যে জিলা বিরথা যাব্যেক, মহুল মদ না খালে।’ হাফ বোতলেই টন টন। আর হাটে পাকুড় গাছের ছায়ায় অ্যালুমিনিয়ামের ছলাৎ ছলাৎ হাঁড়ি নিয়ে বসেছে চকলেট রঙের মেয়েরা সব। শালপাতার ডোঙায় হাঁড়িয়া। সঙ্গে শালপাতার কোনায় রাখা নুন, কাঁচা লঙ্কা দুটো। চাও তো ছোলা ভাজাও।
সব অতীত। আর নেই এসব। খেলা থেমে গেছে। খেলারাম থামিয়ে দিয়েছেন খেলা।
আসলে সবই ছিল ‘ইস্ট’ এর খেলা। নরম ভাতের ভিতর থেকে বের করতো গ্লুকোজ, গ্লুকোজ ভেঙে অ্যালকোহল। ইস্ট আসলে একটা অণুজীব। এককোষী। তাল মহুয়া খেজুরের রস থেকে, ফলের রস থেকে এমন কি ভাত-ভুট্টা-বার্লিকেও ভেঙে দিয়ে মদিরা বানাতো ইস্ট নামের সেই ঈশ্বর কণা ইস্ট। মানুষের জন্মের অনেক আগে থেকেই ধরায় ধরা দিয়েছে ইস্ট। মানুষ তার জন্মের পরই দেখেছে ইস্টের লীলাখেলা। ইস্টকে তো চোখে দেখা যায় না। দেবতার মতোই অদৃশ্য। প্রাচীন গ্রীক বা মদের দেবতা মেনেছে যাকে, তিনিই ইস্ট। নাম দিয়েছিল দিউনাসাস। রোমানরা নাম দিয়েছিল বাক্কাস। এজটেকরা নাম দিয়েছিল হোসি। ভারতের মদের দেবতা কে? সোমদেব? সমুদ্রমন্থনে সবার আগে উঠেছিল হলাহল। তারপর বারুণী। শেষে অমৃত। বারুণী আর অমৃতের মধ্যে তফাৎ খুব একটা ছিল না। সোমদেবের নামেই তো সোমরস। বলরাম বারুণী ভক্ত ছিলেন। আমাদের দেশের নাম গৌড় তো গুড় থেকে তৈরি বিখ্যাত গৌড়ী থেকেই। ওটাই তো পরবর্তীকালে রাম। একটা কহবতই তো আছে— ‘জিন মে তো জানকী হ্যায়, রাম মে খুদ রাম। ব্রান্ডি মে তো ব্রহ্মা হ্যায়— সব মে হ্যায় ভাগয়ান।’
সেই ভগবান খেলা শেষ করে দিয়েছেন। পৃথিবী থেকে উধাও ইস্ট। কিচ্ছু হয় না। ডিনার টেবিলে ওয়াইন নেই আর। বিয়ার শুধু সোডা জল। এমনকি পাউরুটিও ভালো হয় না আর। সেই স্বাদ নেই। দোসাও স্বাদহীন ধোকলা এখন অতি ফালতু। ইস্ট বিদায় নিয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য শৌণ্ডিকালয়ের কথা আছে, বাংলায় যা শুঁড়িখানা। সেসব এখন অতীত। ওখানে স্পা হয়েছে, মেঠাই দোকান হয়েছে, মুদিখানা হয়েছে, দেবালয়ও হয়েছে— দেখালাম তো। আর আমরা এমন আত্মবিস্মৃত জাতি, সুরাদেব সোমের কোনও মন্দির নেই। বলরামেরও হতে পারতো, নিদেন পক্ষে চন্দ্রদেব, যিনি আলো ঢেলে মাতাল করেন। সেটাও করিনি। ধিক!


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

