- August 16th, 2022
ভয় দেখে যায় চেনা (২)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
কলেজে উঠে, মানে যৌবন নিকুঞ্জে পাখি গেয়ে ওঠা শুরু করলে নতুন ভয়ের সন্ধান পাওয়া গেল। প্রেমে প্রত্যাখানের। আমার এক সহপাঠী এ বিষয়ে ছিল অকুতোভয়, সে একের পর এক বান্ধবীকে প্রেম নিবেদন করে দিস্তা দিস্তা চিঠি লিখত, সব ক'টা টার্গেটের বাইরে ছিটকে পড়ত। সে তাতে ভেঙে পড়ত না, পৌরুষে ঘা লাগত না, চিঠির ভাষা সচেতন ভাবে শুধরে নিয়ে ফের পায়রার পায়ে প্রেমপত্র বেঁধে দিত।
ওর দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্ধুকে বাতিল করা এক বান্ধবীকে আমি প্রেমপত্র লিখলাম বিশুদ্ধ বাংলায় যাতে সে প্রত্যাখ্যান করলেও ভাষাটা না বুঝতে পারে। ও মা, দিন কতক পরে ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে দেখি সেই বান্ধবী আসছে বেশ হাসিহাসি মুখে। হাত নেড়ে সেই আমাকে দাঁড় করাল, শরীরের সব রক্ত সেই মুহূর্তে আমার মুখে জমা হয়েছে, ভূতগ্রস্তের মতো দমবন্ধ করে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। 'কী সুন্দর লিখেছিসরে তুই, তবে জায়গায় জায়গায় বড্ড কঠিন।’ শব্দতরঙ্গে এই বাক্য দু’টি উড়িয়ে দিয়ে, নীলাম্বরীর নীল যমুনায় যাওয়ার মতো ছন্দে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সে দিনই আমি উপলব্ধি করলাম প্রেম ঠিক নিবেদন করার বিষয় নয়, ছিনতাই করার। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল ব্যাঁকাও। ধমকে, চমকে রাজি করাও। কী আশ্চর্য, এই উল্টো টোটকায় আমি হাতে গরম ফল পেলাম। বেশ কিছুদিন পিছলে পিছলে যাওয়ার পরে একদিন বঁড়শিতে মাছ গেঁথে গেল, গেল তো গেলই, আঁশের গন্ধে লাইফটাই হেল হয়ে গেল।
খাল কেটে কুমীর ডাকার পরে শুরু হল নতুন ভয়, প্রথমে বান্ধবী তারপরে গিন্নি হয়ে যাওয়া রমণীর কান ভাঙানোর ভয়। গাড়ি হয়তো বড় রাস্তা থেকে এদিক সেদিক খুচরো বান্ধবীর সন্ধানে সরু গলিতে ঢুকেছে, তাঁর কানে ঠিক খবর পৌঁছে দেবে আমার কোনও না কোনও হিতৈষী। নিজে না পারলে অন্যের পোঙায় কাঠি দেওয়া বাঙালি আর কী! বমাল পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ছিঁচকে চোরের মুখের মতো মুখ করে থাক কিছুদিন, খোচরের সন্ধান করতে থাক। এই যে অরওয়েলিয়ান অস্তিত্ব, সারাক্ষণ ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’ মন্ত্র জপে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, ইহারই নাম বিবাহ, দুর্ভাগ্যবান পুরুষের স্থায়ী কয়েদখানা। আর পাঁচ রকম ভয় কেবলই ভয় আর এটা হল মহাভয়। একের বাঁকা দৃষ্টি মানে অন্যের আতঙ্ক, যার পোশাকি নাম প্যারানয়া।
অথচ যাদের ভয় পাওয়া উচিত ছিল, পেলে হয়তো দীর্ঘ কয়েদবাসের নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না, তাদের আমি কখনও সে ভাবে ভয় পাইনি। একেবারে পাইনি বলাটা হয়তো বাতুলতা হবে, বলতে চাইছি ভয়ে পাগল হয়ে যাইনি। যখন ডেকেছে তখনই গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে গিয়েছি, প্রতিবারই সময়ের আগে, যা তথ্যপ্রমাণ চেয়েছে সেটাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছি, ওঁরা যা চেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছি, আগাম-জামিন নিয়ে রেখে নিজেকে সুরক্ষিত করার দুর্ভাবনা মাথাতেই আসেনি। আমার মামলার কাগজে প্রথম যেদিন দেখলাম আমার লড়াই 'রিপাবলিক অব ইন্ডিয়ার' সঙ্গে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলেও অনতিবিলম্বে কিছুটা গর্ব বোধও হয়েছিল। একা কুম্ভ হয়ে লড়ার শিক্ষাটাই হল ভয় পাওয়া। আমি কিন্তু ভয় পাইনি এতটুকু, জামিনে বেরোনোর পরে ইতস্তত চোখা চোখা প্রশ্ন আর গালিগালাজের মধ্যে স্বভাববিরোধী ধৈর্য দেখিয়ে চলেছি ‘সত্যমেব জয়তে’ কবে আসে সেই দিনটির জন্য। দুধকা দুধ পানি কা পানি না হয়ে যাবে কোথায়?
অথচ আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল কেন না গ্রেপ্তার থেকে অতিবিলম্বিত জামিন এই দুর্গম রাস্তায় পদে পদে কী ভাবে হোঁচট খেতে হয়, আমাদের দেশের তদন্ত, আদালত, হাকিম, গুমঘরের অতি কদর্য চেহারা, সব কিছুই বড় কাছ থেকে দেখার ও ঠেকে শেখার অভিজ্ঞতা যার হয়েছে তার তো ভয়ে সেঁধিয়ে থাকারই কথা। আমার ততটা ভয় হয়নি কারণ নিজের বিবেকের কাছে আগাগোড়া আমি পরিষ্কার ছিলাম, শেষ বিচারে ওই বিবেকই মানুষের আয়না, সর্বশক্তিমানদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সেই বিবেকই হয়ে দাঁড়ায় বটগাছের মতো নিপীড়িতের ছায়া সুনিবিড় আশ্রয়স্থল। বিবেক যার সঙ্গে থাকে, কয়েদখানার দুর্লঙ্ঘ পাঁচিল তাকে ভয় দেখাতে ভয় পায় যে! (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

