- August 16th, 2022
 
ভয় দেখে যায় চেনা (১)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ভয় করতে করতেই আমি তিন কাল পেরিয়ে এক কালে এসে পৌঁছে গেলাম। বাকিটুকু যে নির্ভয়ে কাটাব তারই বা গ্যারান্টি কোথায়।
এক্কেরে ছেলেবলায় মা আমায় ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল ঠান্ডা কিছু খেলেই নাকি আমার টনসিল দু’খান বেদানার মতো লাল টুকটুকে হয়ে যাবে, ডাক্তার ছুরি-কাঁচি চালাবে আমার গলায়। সত্যিই তখন বিষয়টা রীতিমতো ভীতিদায়কই ছিল। বছরে বার তিন চারেক টনসিল ফুলে জ্বর আসত, ধূম জ্বর, একশ তিন, একশ চার, গলায় এমন ব্যথা যে মুখে বুলি ফুটতনা, মা ঘাড় ধরে গরম নুন জল দিয়ে গার্গল করাতেন। টুক করে টনসিল দু’টো কেটে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত, সংস্কারবশে মা তা কিছুতেই করতে দেননি। কোত্থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন টনসিল অপারেশন হলে হিতে বিপরীত অবশ্যম্ভাবী, হয় গলার আওয়াজ মেয়েলি হয়ে যাবে নয়তো আমার গলা দিয়ে আর স্বরই বের হবেনা। মায়ের ভয়কে শিরোধার্য করে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টনসিল দু’টোকে বয়ে নিয়ে চলেছি এখনও, এখন অবশ্য তারা বিশেষ একটা বেগড়বাই করেনা, গলার দু’পাশে লক্ষ্মী ছেলের মতো বসে থাকে আর আমার গলাবাজি শোনে।
একটু বড় হতেই শুরু হোল বাবার রাম-প্যাঁদানির ভয়। নিজের সন্তানকে নৃশংসভাবে কেলিয়ে বাবা কি সুখ পেতেন বলতে পারবনা, তবে আমার আর্তনাদে সন্ত্রস্ত পড়শিরা নিগ্রহ দেখতে চারপাশ থেকে দৌড়ে আসতেন।চড়-থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দিলে তাও একটা কথা ছিল, বাবা ক্যালানোর জন্য হাতে অস্ত্র নিতেন, কখনও ছড়ি, কখনও সরু লাঠি, কখনও ইজিচেয়ারের ডান্ডা। রাতে শরীরের বিবিধ ফোলা জায়গায় মা হয় নুনের পুঁটুলির সেঁক দিত কিংবা গরম চুন-হলুদ। মাতালের ছেলে যেমন সচরাচর মাতাল হয়না আমিও তেমনি নিজের বিভীষিকার কথা ভেবে আমার সন্তানদের গায়ে কখনও হাত তুলিনি, আদরের মেয়ের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠেনা, অবাধ্য পুত্রকেও নয়। অবশ্য বদমাইশির খেলায় পুত্র আমার তার বাপের ধারে কাছেও কখনও পৌঁছতে পারেনি। এমন নিরলস প্রশ্রয়ের জন্য গিন্নির কাছে মাঝেমাঝেই মুখ ঝামটা খেয়েছি, গায়ে মাখিনি, তাকে নিরুত্তাপ গলায় ক্রমাগত শুধু বলে গিয়েছি, সন্তানের ওপর হাত তোলার কোনও নৈতিক অধিকারই আমার নেই, ওই বয়সে আমার পুত্রের চেয়ে আমি অনেক বেশি খারাপ কাজ করেছি।
ভূতের ভয়, অন্ধকারের ভয় এমনকী বনবাদারে বিষধর সাপের ভয়ও আমি কখনও পাইনি। আমার জীবনে, সেই প্রাইমারি ইস্কুল থেকে আমার ভূত বলুন, আঁধার বলুন, সাপ বলুন, সব কয়টা ভয় একত্রিত হয়ে একটি অতীব যন্ত্রণাদায়ক ভয়ের গুহায় এসে মিলে গিয়েছিল। অঙ্ক। আমার জীবনের অ্যাকিলেস হিল বা আননেসেসারি ইভল বলতে একমাত্র ছিল ওই অঙ্কই। পাটিগনিত, বীজগণিত, জ্যামিতি কোনও কিছুই মাথায় ঢুকতনা, আঁক কষতে বসে মনে হোত এর চেয়ে মরণও সে যে ভালো। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস এইট অঙ্কের বিষক্রিয়ায ক্রমাগত আমার শরীর নীল হয়ে উঠেছে, বাপ, মাস্টারমশাই মায় শান্তশিষ্ট অতীব স্নেহপ্রবন পিসেমশাইও আমার নির্বুদ্ধিতা দেখে সংযম রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে ঠাস করে বারো সিক্কের এক চড় অতর্কিতে আমার গালে ল্যান্ড করিয়ে দিয়েছিলেন।
বাবার ক্যালানির ভয়ে ক্লাস এইটের মার্কশিটে অঙ্কের ঘর থেকে ৪৭ নম্বরটি হোয়াইটনার দিয়ে মুছে দিয়ে ঠিক উল্টো নম্বর বসিয়ে দিয়েছিলাম, চুয়াত্তর। আর ক্লাস টেনের আবশ্যিক কোর-গণিতে পাশ নম্বর জুটিয়ে নিয়েছিলাম স্রেফ মাস্টারমশাইকে চমকে। তাঁকে বলেছিলাম, স্যার আমি হিউম্যানিটিজ পড়ি অঙ্ক আমার দ্বারা হবেনা বলে। অনেক লাথি-ঝাঁটা খেতে খেতে এই অবধি পৌঁছেছি, এই শেষ গাঁটটা পেরোলেই গঙ্গায় গিয়ে ডুব সাঁতার দেব। দু’বছর ধরে কোর-গণিতে আপনি কক্ষোনো আমায় পাশ করাননি। এবার দয়া করে করাবেন নইলে ক্লাস ইলেভেনে আমায় উঠতেই দেবেনা। স্যার একবার যদি তা হয় গলায় দড়ি দিতে যাওয়ার সময় আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, মনে রাখবেন। উত্তর করেছিলাম ৩৪ নম্বরের, রিপোর্ট এলে দেখলম ৩৯ পেয়েছি। (চলবে)

	
							
Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

