- August 16th, 2022
ভিনগ্রহীদের খোঁজেই কি সর্বনাশের বীজ?
নিজস্ব প্রতিবেদন: লোকটি―থুড়ি, অ্যাংটি―ভারী ভালো। সত্যজিতের গল্পে এই ছিল ভিনগ্রহীকে নিয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ভূগোল স্যারের সার্টিফিকেট। কিন্তু উড়ন্ত চাকতি চেপে মহাশূন্য থেকে ধরাধামে সত্যি যদি কেউ নেমে আসে, সে যে এমন ‘ভালোমানুষ’ গোছেরই হবে, তার গ্যারান্টি কী? বরং হলিউডি সাইফাই হররের চেনা ছকই হয়তো বাস্তব হয়ে উঠবে। পৃথিবীর দখল নিতে মরিয়া অতি-আধুনিক ভিনগ্রহীদের সঙ্গে মানুষের মরণপণ লড়াই। অন্তত বিজ্ঞানীদের একাংশ তাই মনে করেন। তাঁদের সাফ কথা, যাদের সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না এবং যারা গোটা দুনিয়ার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, তাদের সাধ করে ডেকে এনে কাজ নেই!
অন্য গ্রহে প্রাণের খোঁজে বহুদিন ধরেই মহাকাশে কান পেতে আছেন বিজ্ঞানীরা। ভরসা রেডিয়ো টেলিস্কোপ। যদি দূর গ্রহ থেকে ভেসে আসা কোনও সঙ্কেত ধরা পড়ে! এই সব উদ্যোগ পরিচালনার দায়িত্বে মূলত ক্যালিফোর্নিয়ার সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স (সংক্ষেপে সেটি) ইনস্টিটিউট। গত ছয় দশকে প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, পাল্লা বেড়েছে টেলিস্কোপের। কিন্তু মহাশূন্যে প্রাণের হদিস অধরাই। অধৈর্য হয়ে বিজ্ঞানীদের একাংশ তাই এ বার আরও সক্রিয় ভাবে চেষ্টা করতে চাইছেন। অর্থাৎ শুধু সঙ্কেত আসার জন্য অপেক্ষা নয়, বরং নিজে থেকেই ভিনগ্রহীদের উদ্দেশে সঙ্কেত পাঠানো। এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে মেসেজিং এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বা মেটি। আবার বিজ্ঞানীদেরই অনেকের কিন্তু এই পরিকল্পনায় সায় নেই। সেটি বনাম মেটির টক্কর এখন মহাকাশবিজ্ঞানের জগতে টাটকা বিতর্ক।
ইতিমধ্যে গত বছরের এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর কিছু রহস্যজনক ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আনে। আকাশে ঘটে চলা আজব কাণ্ডকারখানা ধরা পড়েছে নৌবাহিনীর বিমানের ইনফ্রারেড ক্যামেরায়। পাইলটরা দাবি করেন, তাঁরা শব্দের চেয়েও বেশি গতিবেগে আকাশে ছুটে বেড়ানো কিছু অদ্ভুত বস্তু দেখেছেন, যেগুলো নাকি চোখের পলকে দিক বদল করছিল। এত দ্রুত গতিপথ বদল মানুষের তৈরি কোনও বায়ুযানের সাধ্যের বাইরে। তাই শুরু হয় জল্পনা। পাইলটরা যা দেখেছেন, তা কি রাশিয়া বা চিনের অভাবনীয় কোনও গোপন গবেষণার ফসল, নাকি ভিনগ্রহীদের মহাকাশযান?
মার্কিন সরকারের একাধিক দপ্তর এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তার ফলাফল প্রকাশ হল বলে! সূত্রের খবর, রিপোর্টে বলা হবে যে, ভিনগ্রহী কার্যলাপের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ পাইলটদের দেখা ঘটনাগুলির কোনও ব্যাখ্যাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ কিন্তু নির্দ্বিধায় বলছেন, কপাল ভালো, তাই ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেনি এখনও! একবার যোগাযোগ হলে সমগ্র মানবসভ্যতা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। আগ বাড়িয়ে ভিনগ্রহীদের ডাক পাঠানোর আগে ভালো করে ভেবে নেওয়া দরকার, কাজটা বুদ্ধিমানের মতো হচ্ছে কি না, বা আদৌ তা কতটা নিরাপদ। ঠিক কী নিয়ে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের?
উত্তরে উঠে আসছে ফার্মি প্যারাডক্স, ইটালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে যে মহাজাগতিক ধাঁধার নামকরণ। দূরের কোনও গ্রহে যদি প্রাণের অস্তিত্ব সত্যিই থেকে থাকে, তাদের সভ্যতা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ, আমাদের ছায়াপথে বেশিরভাগ তারার বয়স সূর্যের চেয়ে ঢের বেশি। সেই সব তারার চারদিকে পাক খেয়ে চলা কোনও গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটে থাকলে মানুষের তুলনায় তাদের বিবর্তনের ইতিহাসও দীর্ঘতর হবে। বৌদ্ধিক বিকাশ এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে তাদের এতদিনে যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা, তাতে ছায়াপথের বাকি অংশ নিয়ে অনুসন্ধান চালানো বা সেখানে উপনিবেশ গড়ার চেষ্টা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক হত। অথচ, তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। এ এক বিরাট রহস্য।
আপাতবিরোধী এই অবস্থার ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে নানা তত্ত্ব। কেউ বলেছেন, উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছলে একটা সভ্যতা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। কারও মতে, ভিনগ্রহীরা মানুষের চেয়ে এতটাই আলাদা যে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াই সম্ভব নয়। কিছু বিজ্ঞানী কিন্তু মনে করছেন, সত্যিটা আরও অনেক সহজ। ভিনগ্রহীরা ঘাপটি মেরে আছে, কারণ, তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় না। তারা জানে, মহাশূন্যে সঙ্কেত পাঠানো তাদের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ঠিক যেমন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে বিপদে পড়তে পারে পৃথিবী। ইতিহাস বলছে, যখনই প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভিন্ন সমতলে থাকা দুটো সভ্যতার মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে, অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা সভ্যতার প্রতিনিধিরা হয় প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করেছে বা নিজের গোলামে পরিণত করেছে। মহাজাগতিক মোলাকাতের বেলাতেও আলাদা কিছু ঘটবে না। আর সেই কারণেই মানুষের উচিত সাবধানে পা ফেলা। আগু-পিছু না ভেবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে গেলে সেটা ভিনগ্রহীদের কাছে আক্রমণ করার নিমন্ত্রণপত্র না হয়ে দাঁড়ায়!
পাল্টা যুক্তিরও অভাব নেই। যাঁরা মহাশূন্যে সঙ্কেত পাঠাতে চাইছেন, তাঁদের দাবি, ভিনগ্রহীদের আক্রমণ নিয়ে ভয়টা অমূলক। মানুষ রেডিয়ো এবং টিভি সম্প্রচারের জন্য আকাশে তরঙ্গ পাঠাচ্ছে এক শতাব্দীর ওপর। যদি উন্নততর কোনও সভ্যতা থেকে থাকে, তারা এতদিনে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছে। আক্রমণ করার হলে অনেক আগেই তারা তা করতে পারত। তা ছাড়া ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগের ফল খারাপই হবে, এটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। উল্টোটাও হতে পারে। উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার মতো যে সব সমস্যা এখন মানব সভ্যতার সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে, ভিনগ্রহীরা হয়তো সেই পর্যায়টা আগেই পেরিয়ে এসেছে এবং তার সমাধানও বার করে ফেলেছে। কে বলতে পারে, তাদের কাছেই নিজেদের টিকিয়ে রাখার নতুন কোনও সূত্র খুঁজে পাবে না মানুষ!
এই সব তর্কবিতর্কের মাঝে উঠে আসছে আরও একটা প্রশ্ন। যে বিষয়টার সঙ্গে গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে, যে পদক্ষেপ পুরো মানব সভ্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার কি শুধু জনাকয়েক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত? আগ বাড়িয়ে মহাকাশে সঙ্কেত পাঠানোর যাঁরা বিরোধী, তাঁদের দাবি, এ বিষয়ে যে সব যুক্তি–প্রতিযুক্তি উঠে আসছে, তার বেশিটাই এখনও জল্পনা। কারণ, নিশ্চিত করে কিছু বলার মতো তথ্য বা প্রমাণ কোনও পক্ষের হাতেই নেই। এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি মানুষের মতামত নেওয়াটা জরুরি। মহাশূন্যে অনুসন্ধানের পরিণাম যাই হোক না কেন, তার দায় পুরো পৃথিবীকে নিতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও সকলের ভূমিকা থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা এবং সর্বসম্মত নির্দেশিকা তৈরির পরেই এ বিষয়ে এগোনো উচিত। তার আগে হুট করে কিছু করে বসাটা চূড়ান্ত হঠকারিতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা হবে।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

