- August 13th, 2022
প্রিয়দর্শিনী তবু নায়ক নন
সুমন চট্টোপাধ্যায়
চোখ বন্ধ করে ভাবলে মনে হয়, এই তো সেদিন!অথচ মাঝখানে নয় নয় করে ৩৭টি বছর পার হয়ে গেল!নেহরুর জমানায় আমার জন্ম, ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় বেড়ে ওঠা। পিতা আর মা হারা কন্যার মধ্যে সম্পর্ক ছিল বড়ই সুমধুর। অথচ কার্যক্ষেত্রে ইন্দিরা ছিলেন পিতার অ্যান্টিথিসিস। দেশভাগের ভূকম্পনে ধ্বস্ত, লাখ লাখ নিরীহ মানুষের রক্তস্নাত, জাত-পাত ধর্মে বিভক্ত একটি হতদরিদ্র অথচ সুবিশাল দেশের অধিনায়ক ছিলেন নেহরু, কেরলে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নির্বাচিত সরকার গায়ের জোরে ফেলে দেওয়া ছাড়া গণতন্ত্র তাঁর জমানায় সেভাবে লাঞ্ছিত হয়নি। আর তাঁরই কন্যার জমানায়? ব্যতিক্রমটাই হয়ে উঠেছিল নিয়ম।
থাক সে কথা। আজ ৩১ অক্টোবর। ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর ছিল বুধবার। আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তার আগের মাসের ২ তারিখে মা হঠাৎ চলে গিয়েছেন, আমাদের দু’কামরার ফ্ল্যাটে আমরা থাকি তিনজনা, বাবা, কস্তুরী আর আমি। রোজ রাতে মাকে স্বপ্নে দেখি, মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠে বসি। এত অকস্মাৎ মা চলে গিয়েছিলেন যে আমি তাঁর শেষ সময়ে পাশে থাকতে পারিনি। সেই অনুতাপ আমার অন্তঃস্থল ফালাফালা করে দিত। বাড়িতে থাকলে মায়ের স্মৃতিচিহ্ণগুলি যেন ভূতের মতো তাড়া করে বেড়াত আমাকে, আমিও তাই সুযোগ পেলেই বাড়ি ছেড়ে পাড়ায় আড্ডা দিতে চলে যেতাম মনটাকে অন্যত্র সরিয়ে রাখব বলে।
সেই বুধবার আমার ঘুম ভাঙল দ্বিপ্রহরের কাছাকাছি। তার আগে টানা ছয় রাত্তির নাইট ডিউটি করেছি, বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত কাবার হয়ে যেত। তখন আমার বয়স আঠাশ, শরীরে সর্বদা কয়েক ঘণ্টার ঘুম বকেয়া থাকত, বিছানায় বডি ফেলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমের দেশে আমি চুটকি মেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতাম। এক্কেবারে কুম্ভকর্ণের ঘুম। ততদিনে আমার এমন ছন্নছাড়া কর্মজীবন কস্তুরীর গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। বৌ তখন দু’বছরের পুরোনো। মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে পায়জামার ওপর একটা ফতুয়া চাপিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম পাড়ার মোড়ের উদ্দেশে। এই অবেলায় বন্ধুদের কাউকে পাওয়া যাবে না জানতাম, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলাম মোড়ে পাঞ্জাবীর ধাবার বাইরে গাছের তলায় খাটিয়ায় বসে এক ভাঁড় পুরু সরওয়ালা পওয়া পাত্তি চা খাব, তারপরে একটা সিগারেট, আর তারপরেই লক্ষ্মীছেলের মতো একচ্ছুটে বাড়ি। আমি সময় দিই না বলে নতুন বৌয়ের মুখ সর্বদা অভিমানে নিকশ কালো হয়ে থাকত। সেদিন পণ করেছিলাম বিকেলে দু’জনে কোথাও একটা সিনেমা দেখে ‘কিম ওয়া’-য় চাইনিজ খেয়ে মানভঞ্জন পর্ব সারব।
মোড়ের মাথায় পৌঁছে আমি তো তাজ্জব। গোটা পাড়াই ওই ভর দুপুরে রাস্তায় নেমে এসেছে, যেদিকে তাকাই জটলা। প্রথম চোটে মনে হল, হয় কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নতুবা পাড়ার কেউ মারা গিয়েছে। ভ্যাবাচ্যাকার মতো এ জটলা থেকে সে জটলায় পা বাড়ানোর সময় কানে এল,‘ বিবিসি যখন খবরটা দিয়েছে তখন তা মিথ্যে হতে পারে না। বিবিসি তো আর আনন্দবাজার নয়।’
প্যাঁকটা আমাকে লক্ষ্য করে দেওয়া হচ্ছে বুঝতে পেরে চোখ ফিরে তাকাতেই দেখি পার্থ মিটিমিটি হাসছে আর হাত নেড়ে ওর কাছে যেতে বলছে। পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে পার্থ ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, আমাদের পরিবারের একান্ত আপনজন।
আমি পার্থর কাছে পৌঁছেই চারটে কাঁচা খিস্তি শুনিয়ে দিলাম। ‘এই গান্ডু কী এত বিবিসি বিবিসি মারাচ্ছিলি রে! বিবিসি-র পুরো নামটা নির্ভুল বলতে পারবি কাউকে জিজ্ঞেস না করে?’ পার্থ রাগল না, কেবল ঘোর অবিশ্বাসী চোখে আমাকে প্রশ্ন করল, ‘সে কী রে, তুই এখনও জানিস না? আমি তো ভাবলাম তোর কাছেই বিস্তারিত খবর থাকবে!’ কী খবর রে? আরে ইন্দিরা গান্ধীকে ওঁর দেহরক্ষীরাই নাকি গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বিবিসি একবার খবরটা দিয়ে চুপ করে গিয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কিছু বলছে না। এত বড় খবর আর তুই জানিস না? পার্থর সঙ্গে বৃথা তর্ক করতে আর মন উঠল না। ওর কথার জবাব না দিয়ে এক ছুটে ফিরে এলাম ফ্ল্যাটে। বাবা বাইরের ঘরে নিজের ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, কস্তুরী রান্না ঘরে। দু’জনেই শুনতে পারে এমন চড়া গলায় বলে উঠলাম, ইন্দিরা ইজ কিলড বাই হার ওন বডিগার্ডস!
আমাদের বাড়িতে তখন টেলিফোন নেই, ফোন করে অফিস থেকে খবর নেব সে রাস্তা বন্ধ। একটা পেল্লাই সাইজের এইচ এম ভি রেডিও ছিল, একটা টুল পেতে তার সামনে বসে নব ঘোরাতে থাকলাম, বাঁদিক থেকে ডানদিক, আবার ডানদিক থেকে বাঁদিক। কেউ কিছু বলছে না শুধু সেতার বাজছে। কস্তুরীকে বললাম, ‘আমি স্নান করতে যাচ্ছি। যা রান্না হয়েছে তাই দিয়েই আমাকে খেতে দিয়ে দাও, অফিসে যাব।’ এমন উত্তেজিত আর আবেগমথিত গলায় কথাগুলো বললাম যে বাবা বা গিন্নি কেউই প্রতিবাদ করার অবকাশই পেল না। ঘন্টা দেড়েকের ব্যবধানে পাড়ার মোড়ের ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে। সব দোকান পাটের ঝাঁপ বন্ধ, রাস্তা একেবারে শুনশান, লন্ড্রির সামনে ইন্দিরার একটা বড় ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে কারা যেন। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ, কেউ কোথাও নেই। বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। মোড়ের ওপর সারিসারি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, সব কয়টার মিটার লাল শালু দিয়ে মোড়া। এই ট্যাক্সিগুলোর চালকদের বেশিরভাগই শিখ। বাসস্টান্ডের পিছনে বন্ধ সেলুনের সামনে একটা জলচৌকির ওপর বসেছিল আমার চেনা কারিগর। সেই খবর দিল শিখেরা সবাই ভয়ে গরচার গুরুদ্বারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, বৌবাচ্চা, লোটা কম্বল নিয়ে। শিখেরা কেন সন্ত্রস্ত বোধ করবে, তখনও পর্যন্ত আমার তা মাথাতেই আসেনি। আমাদের ফ্ল্যাটের একেবারে নীচের তলায় গাদাগুচ্ছের ছেলেপিলে নিয়ে এক শিখ রমণী থাকেন। তাঁর স্বামী তাইল্যান্ডে কোনও এক গুরুদ্বারের গ্রন্থী। সম্বৎসরে একবার আসেন, মাসখানেক
থেকে ফিরে যান। গলিতে আরও এক শিখ পরিবারের বাস। বিধবা মা তিন জোয়ান ছেলেকে নিয়ে থাকেন। শীতের দুপুরে দেখেছি তিন ভাই রাস্তার ওপর পরপর মোড়ায় বসে লম্বা ঘন কালো চুল পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়ে বসে আছে, ওদের মা এক এক করে সবার চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন। দেওদার স্ট্রিটে আমাদের পাড়াটা ছিল মিনি ভারবর্ষের প্রতিবিম্ব। কয়েক ঘর শিখ আমাদের বড় আপনজন।
বাসের আশায় সময় নষ্ট করা মূর্খামি বুঝতে পেরে অগত্যা এগারো নম্বর বাসে চেপে বসলাম। মাথার ওপর ঠা ঠা রোদ। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, বেকবাগান, রডন স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, ম্যাডান স্ট্রিট হয়ে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে ঢুকতে ঘন্টাখানেক বেশি সময় লেগে গেল। মনে হল যেন কার্ফু কবলিত শহরের ভিতর দিয়ে পথ চলে এলাম। সরকারিভাবে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি তবু গোটা শহর কেমন যেন এক অজানা আশঙ্কায় ঘরে ঢুকে দুয়ারে কপাট দিয়ে বসে আছে।
অফিসে এক তলার রিসেপশনে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। তারপর লিফ্টে চারতলায় উঠে দেখি নিউজ রুমে লোকজন তেমন একটা নেই। সহকর্মীদের আনতে অফিস থেকে চারদিকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে, সন্ধ্যের আগেই সবাই পৌঁছে যাবে। আমিই একমাত্র আহাম্মক যে ছুটির দিনে গলদঘর্ম হয়ে হাঁটতে হাঁটতে অফিসে পৌঁছে গিয়েছি নিজের তাগিদে।
আনন্দবাজারের বার্তা বিভাগে তখন আমি নেহাতই নবীন, মাত্র বছর খানেক হল এখানে এসেছি। প্রথম ছয় মাস রিপোর্টারি করার পরে আমাকে বদলি করা হয় নিউজ ডেস্কে। সেদিন আমি ডেস্কেরই কর্মী। সন্ধ্যা নামার কিছু আগে হন্তদন্ত হয়ে সম্পাদক অভীক সরকার নিউজ রুমে প্রবেশ করলেন, সোজা গিয়ে বসলেন বার্তা সম্পাদকের চেয়ারে। সেই থেকে রাত আড়াইটেয় প্রথম পাতা ছাপতে যাওয়া পর্যন্ত ওই চেয়ারেই অভীকবাবু ঠায় বসে ছিলেন, কাগজটা তৈরি করেছিলেন নিজের হাতে। আমার দায়িত্ব ছিল খুশবন্ত সিংহ আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পাঠানো ইংরেজি লেখা বাংলায় তর্জমা করা। তখন টেলেক্স,টেলিপ্রিন্টারের যুগ, ওঁদের দুজনের লেখাই এসেছিল টেলিগ্রামে। অনুবাদের চেয়েও কষ্টের ছিল পাঠোদ্ধার। পরিশ্রম বৃথা যায়নি, সম্পাদক আমার পিঠ চাপড়ে ফুল মার্কস দিয়েছিলেন।
বার্তা সম্পাদক বিজয় চক্রবর্তীর কাছ থেকে অভীকবাবু শুনেছিলেন, ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও আমি সেদিন হেঁটে হেঁটে স্বেচ্ছায় অফিসে এসেছি। শুনে সম্পাদক মহাশয় বেশ প্রসন্ন হয়েছিলেন। কাজের ফাঁকে একবার টেবিলে নিয়ে জানতে চাইলেন, কেন আমি অফিসে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিলাম,‘আপনিই বলুন এমন একটা দিনে বাড়িতে বসে থাকা যায়?’
ইন্দিরার আকস্মিক, মর্মান্তিক হত্যা বাকি ভারতবাসীর মতো আমাকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। যদিও আমি কোনও দিন ইন্দিরার ভক্ত বা গুণগ্রাহী হতে পারিনি। বরং আমি বরাবর এ কথা বিশ্বাস করে এসেছি যে, এদেশে সব কয়টি গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ইন্দিরা নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন কেবল ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে। ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী সন্দেহ নেই, আমার চোখে তিনি নায়ক নন। এ সব কথা নিজের কলামে আমি অনেকবার লিখেছি। আজ তাঁর মৃত্যুদিনে সেই সব অপ্রিয় কথার পুনরুক্তি নাই বা করলাম।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

