- August 13th, 2022
হারিয়ে গিয়েছে আমার আখরগুলি…
হারিয়ে গিয়েছে আমার আখরগুলি...
সুমন চট্টোপাধ্যায়
I never travel without my diary. One should always have something sensational to read in the train
(Oscar Wilde in The Importance of Being Earnest)
প্রতিজ্ঞা করছি সেই কবে থেকে? অন্তত পঞ্চাশ বছর তো হবেই। রক্ষা করা আর হয়ে উঠল না কিছুতেই।
বছর কয়েক আগে পর্যন্ত আমার নিউ ইয়ার’স রেজলিউশনে তিনটি শপথবাক্য থাকত — সুরার হাতছানিতে কিছুতেই সাড়া দেব না, ধূমপান ত্যাগ করব আর পয়লা জানুয়ারি থেকে এক্কেবারে নিয়ম করে রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে ডায়েরি লিখব। ঠ্যালার নাম বাবাজি বুঝতে পারার পরে প্রথম দু’টি বদভ্যাস বর্জন করতে বাধ্য হয়েছি অথচ তৃতীয় সদভ্যাসটি এখনও রপ্ত করে উঠতেই পারলাম না। মাঝেসাঝে হয়তো চাগাড় দিয়ে উঠে পর পর কয়েক দিন লিখে ফেলেছি, তার পর অনিবার্য পূর্ণচ্ছেদ।
চরিত্রে শৃঙ্খলা না থাকলে নিয়মিত ডায়েরি লেখা অসম্ভব। আমার ক্ষেত্রে সমস্যাটা হল, জ্ঞান হওয়া ইস্তক ‘শৃঙ্খলা’ শব্দটির সঙ্গে আমার পরিচয়ই হয়ে উঠল না। সময় আর মালিকের সেবা ব্যতীত আর কোনও কাজে আমি ধারাবাহিকতা দেখাতে পারিনি। আজ বৈতরণী পারের কাছে এসে পিছনে তাকিয়ে তার জন্য খুবই আফশোস হয়, হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে। ইশ্, একটু সংযম আর শৃঙ্খলা দেখাতে পারলাম না! ডায়েরি লেখা তো অঙ্ক কষা নয়, যে নাম শুনলেই আমার পিলে চমকে যেত! এটা এমন একটা কাজ যা আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল, প্রয়োজন ছিল দিন-রাতের মধ্যে একটু সময় বের করে যা মনে আসে সেটাই লিখে ফেলা। এই সহজতম কাজটিতেও দিনের শেষে আমি গোল্লাই পেলাম।
ডায়েরি লেখার সুবিধে অনেক। সারা জীবন ধরে ডায়েরি লিখে যাওয়া ভার্জিনিয়া ওলফ বলেছিলেন, ‘এটা ভালো অভ্যেস, শরীরের লিগামেন্টগুলো শিথিল হয়ে যায়, কোথাও ভুল করলে বা হোঁচট খেলেও কিছু যায় আসে না। ডায়েরি একান্ত ভাবে আমার আপন এবং গোপন কথা, কাউকে শোনানোর বা পড়ানোর দায় নেই, প্রকাশ করা তো দূরস্থান। ডায়েরি মানে আমার সঙ্গে আমারই সংলাপ, নিজেকে মেলে ধরা, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মনোরম সহবাস। এই যে পার্থিব সব কিছুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যাকে ‘সাবজেক্টিভিটি’ নাম দিয়ে তুচ্ছ করা হয়, সেটাই আসলে স্বকীয়তা, ব্যক্তিত্ব এবং মৌলিকতার ভরকেন্দ্র। লিখতে লিখতে লেখার উন্নতি হয়, ঘষতে ঘষতে হিরের ঔজ্জ্বল্যপ্রাপ্তির মতো। নিয়িমত লিখতে পারলে ডায়েরি শুধু আর দিনলিপি থাকে না, বিভিন্ন বিষয়ে নিজের পরিবর্তনশীল অবস্থানটিও সম্যক ধরা পড়ে।
অবশ্য আমার ক্ষেত্রে এ সব কথা বলা অর্থহীন। চোর পালিয়ে যাওয়ার পরে মগজাস্ত্রে শান দিয়ে আর কী লাভ? ডায়েরির পাতাগুলো থাকলে এই পড়ন্ত বিকেলে আবার হারানো দিনগুলি আমার মতো করে ফিরে পাওয়া যেত, কখনও আনন্দ কখনও আবার বিষাদে ডুব দিত মন। যা হারিয়ে যায়, তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করা সম্ভব। যা কোনও দিন ছিলই না, তাকে আর ধরে রাখব কেমন করে?
নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো ‘এলিফেন্টাইন মেমোরি’ থাকলে আজ হয়তো ডায়েরির অভাব সে ভাবে বোধ করতাম না। অক্সফোর্ডের লাথবেরি রোডে তাঁর বাড়িতে বসে বহুকাল আগে নীরদবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কোনও ডায়েরি বা নোটের ধার ধারিনি। যা লিখেছি তার সবটুকু স্মৃতি থেকে, কোনও ঘটনার বছর বা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ লেখার আগে আমার বইঘাঁটারও প্রয়োজন হয়নি। জীবনে একবার যেটা পড়েছি বা শুনেছি আমার মস্তিষ্কের কোষে তা চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে, পরে প্রকাশকেরাও আমার কোনও ভুল ধরতে পারেনি।’ আত্মম্ভরিতাই ছিল নীরদচন্দ্রের সিগনেচার, তবু তাতে সত্যের অপলাপ থাকত না। যেমন নীরদচন্দ্র মনে করতেন, কোনও ব্যক্তি যথার্থ ভদ্রলোক হলে বাড়িতে হার্ড-বাউন্ড ছাড়া কোনও বই ঢুকতেই দেবেন না। কিংবা তিনি এটাও মনে করতেন যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই বাংলা সাহিত্যে সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিক। তাঁর পরে বাংলায় পাতে দেওয়ার মতো কোনও উপন্যাসই লেখা হয়নি। নীরদচন্দ্রের সঙ্গে তর্ক করা ছিল অর্থহীন, আমার মতো অর্বাচীনের তো সে পথ মাড়ানোর কোনও প্রশ্নই ছিল না। নীরদবাবু ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের ওরাকেলের মতো। তাঁর ভাবখানা ছিল, ‘আমি বলছি যখন তখন সেটাই ধ্রুব সত্য, বাকিরা কে কী বলল, কী ভাবল তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।’
দু’জন মানুষের কথা এই মুহূর্তে আমি মনে করতে পারছি, যাঁদের বলা চলে ‘কমপালসিভ ডায়েরি রাইটার’। দু’জনেই রাজনীতিক, দু’জনেই প্রয়াত। প্রথম জন ইংল্যান্ডের যশস্বী লেবার এমপি ও মন্ত্রী টনি বেন। দ্বিতীয়জন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
বছরটি ঠিক মনে করতে পারছি না (এই দেখুন ডায়েরি না লেখার মাশুল কী ভাবে গুনতে হচ্ছে), টনি বেনকে কলকাতার নেতাজি ভবনে এসে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি তখন দিল্লিতে থাকি, আমার পিতৃসম শিশির বসু বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলেন, বেনকে সঙ্গে করে আমি যেন কলকাতায় আসি। দিল্লি বিমানবন্দরের যাত্রী লাউঞ্জে বসে আছি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান ধরব বলে। এ দেশের আকাশ তখনও উন্মুক্ত হয়নি, যেখানেই যান না কেন বিমান মানে সবেধন নীলমণি ওই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস যা কখনই ঠিক সময়ে ছাড়ে না। সে দিনও বিলম্বের নিয়মে ব্যত্যয় হল না। রাশভারী চেহারার মানুষ হলেও এই সম্মাননীয় শ্রমিক নেতা আমার মতো নো-বডির সঙ্গে খোশগল্প করছিলেন জমিয়ে, বিলেতের রাজনীতিকদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা-ইয়ার্কিও করলেন। টার্মিনালের লাউড স্পিকারে বিমান বিলম্বের ঘোষণা শোনা মাত্র বেন সাহেব হাতের আ্যাটাচিটা খুলে একটা দশাসই চেহারার ডায়েরি বের করে তাতে লিখতে শুরু করে দিলেন। বিমানে ওঠার পরেও তাঁর কলম থামল না, আকাশপথে টানা দু’ঘণ্টা ধরে আমি দেখে গেলাম পারিপার্শ্বিক সব কিছুকে বেমালুম অবজ্ঞা করে একজন মানুষ কতটা তন্ময় হয়ে ডায়েরি লিখতে পারেন। কলকাতায় নেমে বেন আমাকে বলেছিলেন, ‘কাজের মধ্যে ফুরসত পেলেই তিনি ডায়েরি লিখে থাকেন। এটা তাঁর আশৈশব অভ্যেস। ডায়েরি না লিখে বিছানায় গেলে তাঁর ঘুমই আসবে না।’
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ডায়েরি লিখতে আমি দেখিনি। তিনি যে রোজ ডায়েরি লিখতেন, সে খবর তাঁর মুখ থেকেই শুনেছি। ডায়েরি লেখা ছিল প্রণববাবুর দৈনন্দিন শেষ কাজ। গভীর রাতে দর্শনার্থীরা বিদায় নিলে, ফাইল দেখার পর্ব চুকিয়ে তিনি ডায়েরি খুলে বসতেন। সেটা রাত আড়াইটেতেও হতে পারে। জীবদ্দশায় তাঁর ডায়েরি প্রণববাবু দ্বিতীয় কাউকে দেখাননি। আমাকে বলেছিলেন, ‘এ পর্যন্ত যতগুলি ডায়েরি লিখেছি, সবটাই মুন্নির (মেয়ে, ভালো নাম শর্মিষ্ঠা) হেফাজতে আছে। ওকে বলে দিয়েছি, কোনও দিন যেন এ সব প্রকাশ না পায়।’
প্রণব মুখোপাধ্যায় ও সমকালীন রাজনীতি নিয়ে ‘এই সময়’ কাগজে প্রায় বছর খানেক ধারাবাহিক লেখার পরে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। নাম ‘প্রথম নাগরিক’, প্রকাশক ‘কারিগর’। সেই বইয়ের প্রকাশানুষ্ঠানে এসে প্রণববাবু বলেছিলেন, মন্ত্রগুপ্তির শপথের প্রতি তাঁর আনুগত্য থাকবে চিরজীবন। ফলে অনেক গোপন কথা তাঁর সঙ্গে পরপারে চলে যাবে, কেউ তা জানতে পারবে না। আরও অনেকটা সময় গেলে শর্মিষ্ঠা যদি তাঁর দেরাজে থাকা গুপ্তধন প্রকাশ্যে আনতে সম্মত হন, সেই সব গোপন কথার কিছু কিছু আমরা হয়তো জানতে পারব। রাজনীতির অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও হয় অজানা নতুবা অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে। সেই সব রহস্য উদ্ঘাটনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরির গুরুত্ব অপরিসীম।
বিখ্যাত লোকেদের অনেকে ডায়েরি বা জার্নাল লিখে গিয়েছেন, আমরা জানি। সেই তালিকাটিও বেশ দীর্ঘ। তাঁদের মধ্যে শিল্পী, লেখক, বৈজ্ঞানিক, পর্যটক সবাই আছেন। তেমনি আবার বিপরীত দিকটিও একই রকম সত্য। ডায়েরি লেখার জন্য বিখ্যাত হওয়ার প্রয়োজন হয় না, ক্ষেত্র বিশেষে আবার খেলাচ্ছলে ডায়েরি
লিখেও একদিন ভুবনজোড়া খ্যাতি জুটে যেতে পারে। যেমন অ্যানি ফ্র্যাঙ্ক। নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে অন্যের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় মাত্র তেরো বছরের ইহুদি কিশোরী যখন ডায়েরি লিখতে শুরু করলেন, তাঁর মনেও উঁকি মেরেছিল গভীর সংশয়। “For someone like me it is a very strange habit to write in a diary. Not only that I have never written before but it strikes me that later neither I, nor anyone else, will care for the outpourings of a thirteen year old school girl.” অ্যানি ও তার পরিবার নাৎসিদের হাত থেকে পরিত্রাণ পায়নি। কিন্তু ওই ডায়েরিটার কী পরিণতি হয়েছে সেটা এখন ইতিহাস।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

