- August 13th, 2022
বইটা যদি না পড়তাম…
বইটা যদি না পড়তাম…
সুমন চট্টোপাধ্যায়
কুড়ি বছর বয়সে কেউ যদি কমিউনিস্ট না হয়, ধরে নিতে হবে সে পাগল। আর চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছেও কেউ যদি কমিউনিস্ট থেকে যায়, ধরতে হবে সে বদ্ধ উন্মাদ।
আমাদের ছেলেবেলায় এই রসিকতাটি অহরহ শুনতাম। আজকের ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচার’ যুগে কতজন ছেলে কমিউনিস্ট হতে চাইবে সন্দেহ আছে। কিন্তু ষাট-সত্তর-আশির দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে সেটাই ছিল দস্তুর। অশোক মিত্র মশাই ‘আমি ভদ্রলোক নই, কিমউনিস্ট’ বলে যতই আস্ফালন করে থাকুন না কেন, আসলে দীর্ঘ সময় ধরে এই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ভদ্দরলোকের ছেলের কমিউনিস্ট না হওয়াটাই ছিল পরম আশ্চর্যের। কমিউনিস্ট মানে পার্টির লাল কার্ডধারী হতে হবে তা নয়, বৃহদার্থে কথাটা নিতে হবে। বামপন্থী।
বাংলায় কমিউনিস্টদের উত্থান এবং পতন, দু’টোই ঘটেছে আমার চোখের সামনে। শৈশবে নকশাল আন্দোলনের ওম লেগেছে গায়ে, ৬৭-তে ‘কানা-অতুল্যর’ পতন দেখেছি তার পর কর্মজীবনের তিন-চতুর্থাংশ কেটেছে বাম জমানায়। আমার পরিবারে সেই অর্থে কেউ কখনও সক্রিয় রাজনীতি করেনি। যদিও ওই বৃহদার্থে সবাই বামপন্থী। আমার পিতৃদেব জীবনে কখনও কংগ্রেসকে ভোট দেননি, বাম জমানার শেষ দিকে সিপিএমের ওপর বেদম চটে গিয়ে ভোট দিতেন এসইউসি-কে। বাবার কথায়, এরা সিপিএমের চেয়ে খাঁটি বামপন্থী।
আমি এমনই বেয়াদপ, কোনও দিন ভেবেই উঠতে পারলাম না বাম নাম সত্য হ্যায়। বামপন্থী হওয়ার জন্য যত রকম প্রণোদনা থাকা সম্ভব তার সব কিছুই মজুত ছিল, তবু অন্তরের টান অনুভব করলাম না একেবারেই, না বছর কুড়িতেও নয়।
তার মানে আমি কোন গোত্রে পড়লাম? উন্মাদ না বদ্ধ উন্মাদ? নাকি কোনওটাই নয়? জীবনের কোনও বাঁকে যে কমিউনিস্ট হওয়ার সামান্য তাগিদটুকু অনুভব করেনি তাকে কী বলা উচিত? সেয়ানা পাগল ?
আমি নিজেও যে প্রশ্নটি নিয়ে কখনও ভাবিনি তা নয়, কিনারা করতে পারিনি। বঙ্গজ কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আমার জাতক্রোধ ছিল না কোনও দিন। যদিও তাঁরা আমাকে পতিত বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা সিআইএ-র দালাল ব্যতিরেকে আর কিছুই কখনও মনে করেননি। তাঁদের অনেককে সামনে থেকে দেখেছি, শ্রদ্ধা ও সম্মান করেছি, তাঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সন্ন্যাসীসুলভ জীবনাদর্শকে সেলাম ঠুকেছি বারেবারেই। আবার তাঁদের দেখেছি বলেই বোধহয় পরবর্তী প্রজন্মের ভণ্ড বামপন্থীদের নম্বর দিতে বাধোবাধো ঠেকেছে। যতই দেখি বা শুনি, কখনও কমিউনিস্ট আদর্শ আমাকে আকৃষ্ট করেনি।
নিজের মনে কারণানুসন্ধান করতে গিয়ে হঠাৎ একটি বইয়ের প্রচ্ছদ চোখের সামনে ভেসে উঠল, ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান ডেনিসোভিচ’। ঝরঝরে পরিষ্কার গদ্য, এই বইয়ের কাহিনির কেন্দ্রে ছিল একজন নেহাতই সাধারণ শ্রমিকের দিনযাপনের বৃত্তান্ত, যে হাড়ভাঙা খাটুনি সত্ত্বেও কেবল নীরবে চোখ বুজে অবিচার আর অত্যাচার সহ্য করে। কে আমার হাতে বইটি তুলে দিয়েছিল মনে নেই, এটুকু মনে আছে তখন আমি টেন-অথবা ইলেভেনে পড়ি। পড়ার সময় দারুণ উত্তেজিত বোধ করেছিলাম, গায়ের রোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। লৌহ-পর্দার অন্তরালে ঢাকা পড়ে থাকা এই অজানা কাহিনি সেই যে আমার মনে কমিউনিস্ট ব্যবস্থা সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন তুলে দিল, বাকি জীবনে তার সদুত্তর পাওয়া হল না একেবারে। বারবার মনে হতে শুরু করল এই যদি লেবার ক্যাম্পের (যা গুলাগ নামে কুখ্যাত) আসল চেহারা হয় তাহলে বাংলার কমিউনিস্টরা এত লম্ফঝম্ফ করেন কী নিয়ে?
বইটির লেখক যিনি, যৌবনোচ্ছাসে তিনিও কমিউনিস্টই হয়েছিলেন। খোদ রাশিয়াতেই। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তাঁরও ছিল প্রগাঢ় আস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জান কবুল করে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন হিটলারকে রুখে দেওয়া লাল ফৌজে, গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডারও হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম আর অসীম সাহসিকতার জন্য তাঁর ভাগ্যেও জুটেছিল দু’টি শৌর্য পদক। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি এই ছেলেটিই একদিন সোভিয়েত ব্যবস্থার বীভৎসতাকে গোটা দুনিয়ার সামনে বে-আব্রু করে ছেড়ে দেবে, একা কুম্ভ হয়ে লড়ে যাবে একটা সাম্রাজ্যের মিথের বিরুদ্ধে।
ভদ্রলোকের জীবনে নাটকীয় মোড় এল ১৯৪৫ সালে যখন হঠাৎ সোভিয়েত-বিরোধী ক্রিয়াকলাপের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল। কী তাঁর অপরাধ? না এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে তিনি মহামতি স্তালিন আর লাল ফৌজের সমালোচনা করেছেন। এক্কেবারে যেন ‘ডিকেনসিয়ান রিভার্সাল!’
হয়তো শাপে বরই হল। দণ্ডিত হয়ে তিনি মুখোমুখি হলেন সত্যের, প্রদীপের তলায় অন্ধকার কতটা গাঢ় তা চাক্ষুষও করলেন। সর্বহারার নাম করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের স্বরূপ তাঁর চোখের সামনে একটু একটু করে উন্মোচিত হতে শুরু করল। তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি সব চটকে গেল, পণ করলেন, স্তালিনীয় সন্ত্রাসের এই কদর্য চেহারা পরতে পরতে উন্মোচন করাটাই হবে তাঁর বাকি জীবনের ব্রত। করলেনও তাই। ‘ওয়ান ডে ইন দ্য লাইফ অব ইভান ডেনিসোভিচ’-এর পরে এল ‘দ্য ফার্স্ট সার্কেল’, তারও পরে ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’। এ সবের মাঝে বরিস পাস্তেরনাকের ‘ড: জিভাগো’-ও পড়া হয়ে গিয়েছে, আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে কোন আজাদিটা সত্যিকারের ‘ঝুটা’।
ইতিহাস এই লেখকের জবানীকে সত্য প্রমাণ করেছে, ১৯৯১ সালে ভেঙে টুকুরো টুকরো হয়ে গিয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। রিপোর্টার হিসেবে সেই ঐতিহাসিক পালাবদলও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে আমার। লেখক বীরের সম্মান নিয়ে দেশে ফিরেছেন, শোনা যাচ্ছে এ বার মস্কোয় মূর্তি তৈরি হবে তাঁর।
লেখকের নাম আলেকজান্দার সলঝনেৎসিন। গত ১১ ডিসেম্বর তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হল। তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম আর অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমার মতো অর্বাচীনের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য। এমন একটা সময়ে যখন জেগে ঘুমিয়ে থাকাটাই ছিল বিপ্লবীদের ধর্ম!
আমার যে আর এ জীবনে কমিউনিস্ট হওয়া হল না তার কৃতিত্ব অনেকটাই এই নোবেলজয়ী লেখকের।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

