- August 12th, 2022
এ কী বিপন্নতা
এ কী বিপন্নতা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
এ বার কাউকে শুভ নববর্ষ বলিনি। সচেতন ভাবেই বলিনি। কেন না, কয়েদের অন্তঃপুরে থেকেও বিলক্ষণ বুঝতে পারছি ১৪২৭ বঙ্গাব্দে কোনও কিছুই শুভ হওয়ার সম্ভাবনা কম, একেবারে নেই বললেই চলে। প্রশ্ন একটাই, নতুন বছর কার ক্ষেত্রে কতটা গুরুতর ভাবে অশুভ হবে।
বিমুদ্রাকরণের ধাক্কায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয়েছিল, সেই ক্ষত এখনও সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি। তবু সেটা ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বাকি বিশ্বের তাতে কিছু যায় আসেনি। এ বার বিশ্ব-জোড়া অতিমারি নামক অতি ভয়ঙ্কর ভূকম্পনের পরে গোটা দুনিয়ায় যে আর্থিক মন্দা শুরু হবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন তার ভয়াবহতা ১৯৩০ এর দশকের মহা-মন্দাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। চিনা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যেই স্বীকার করে নিচ্ছেন গত অর্ধ-শতক ধরে বিরামহীন আর্থিক বৃদ্ধির পরে এবার তাঁদেরও নাকানি-চোবানি খাওয়ার সম্ভাবনা। মার্কিন মুলুকে করোনা-মড়কে রোজ যত লোক মারা যাচ্ছে তার কয়েক গুণ বেশিমানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। ফরফরিদাস ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখটা এখনই কেমন শুকনো আমসত্ত্বের মতো দেখাচ্ছে, মহামারির গোড়ায় থোড়াই কেয়ার ভাব দেখানোর পরে বরিস জনসন টের পেয়েছেন এ বার বিলেতের অর্থনীতিকেও তাঁর মতো ইনটেসিভ কেয়ার ইউনিটে ঢুকতে হতে পারে। খাবি খাচ্ছে ইউরোপও।এমন একটা সার্বিক ভুবনজোড়া বিপর্যয়ের রেশ আছড়ে পড়বে ভারতের ওপরেও। টাইটানিক ঝড়ের দোলায় টালমাটাল হয়ে গেলে ডিঙি নৌকো পাল তুলে সমুদ্রে অবলীলায় হাওয়া খেয়ে বেড়াতে পারে নাকি?
দুশ্চিন্তা সকলের, দুশ্চিন্তা আমারও। যে বয়সে পৌঁছনোর পরে ভদ্রলোকেরা সাধারণত নিশ্চিন্ত অবসর জীবন কাটিয়ে থাকেন, আমি তখন শারীরিক-মানসিক-আর্থিক সব দিক দিয়ে একেবারে বিপর্যস্ত। কারাবাসের মেয়াদ ফুরোলে ঘটি-বাটি বেচে আমায় ঋণ চোকাতে হবে সেই সব শুভার্থীর যাঁরা এই বিপদের মাঝে আমায় অকৃপণ ভাবে সাহায্য করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। খাঁচা থেকে বের হয়ে আমাকে পড়তে হবে কূল-কিনারাহীন অতল দরিয়ায়। হবেই।
তবু নিজেকে নিয়ে আমার সত্যিই ততটা উদ্বেগ নেই। সাত-তারা হোটেলের মখমলের বিছানার মতো ছারপোকা-ক্লিষ্ট রিকশাওয়ালার খাটিয়ার ওপরেও আমি সমান স্বচ্ছন্দ। তার ওপরে এই অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ জেল-বাসের পরে নতুন করে বুঝতে পেরেছি জীবনধারণের জন্য মানুষের সত্যিই কতটুকু প্রয়োজন। আমি মাস্টারের ছেলে, কাঁঠাল কাঠের তক্তোপোষে শুয়ে বড় হয়েছি, কলেজে যাওয়ার আগে হাতে ঘড়ি ওঠেনি, বাবার নেক-নজরের মধ্যে থেকে হাফ-প্যান্ট ছেড়ে ফুল-প্যান্টে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি ক্লাস ইলেভেনে ওঠার পরে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে আর কতদিন বাতাস থেকে অক্সিজেন নেওয়ার ক্ষমতা বজায় রাখতে পারব, সেই হিসেবটাও তো ছাই জানা নেই! তবে সবিনয়ে নিজের সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি, আমার মস্তিষ্ক আর হাত দুটো যদি মোটামুটি সচল থাকে, ডাল-ভাতের ব্যবস্থা আমি ঠিক করে নিতে পারব।
কিন্তু আমার গভীর দুশ্চিন্তা হচ্ছে সতীর্থদের নিয়ে যাদের সান্নিধ্যে আমি নয় নয় করে প্রায় ৪০টি বছর কাটিয়ে ফেলেছি। মিডিয়ার চাকরিতে নিরাপত্তা উঠে গিয়েছে অনেক কাল হল। বাড়ির কাজের লোককে ছাড়িয়ে দেওয়া আজ একজন সাংবাদিককে তাড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে কঠিন ব্যাপার। সর্বত্র, সবার চাকরি চুক্তি-ভিত্তিক, এক মাসের বেতন অগ্রিম দিয়ে মালিক যে কাউকে বলে দিতে পারে, কাল থেকে আর অফিসে আসার কষ্ট করতে হবে না। সম্প্রতি কলকাতায় একাধিক মিডিয়া হাউসে একেবারে নীরবে কয়েক’শ লোকের এ ভাবে চাকরি গিয়েছে, কেউ কোথাও কোনও প্রতিবাদ করেনি, করার সাহসটুকুই হারিয়ে ফেলেছে সকলে। শাসকের অথবা মালিকের চাপরাশিরা দখল করে আছে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন, নিজেদের জন্য কলাটা-মুলোটা পেলেই তারা বেজায় খুশি !
করোনা মহামারির ত্রাস আবার সেই সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। রয়টার্সের একটা খবরে দেখলাম, দেশের সব কয়টি বড় মিডিয়া গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই হয় লোক নয়তোবা বেতন ছাঁটাইয়ের পাঁয়তারা শুরু করে দিয়েছে। বৃহত্তম গোষ্ঠীতে এই সেদিনই একসঙ্গে ৩৫জন সাংবাদিককে ‘রাম রাম’ করে দেওয়া হয়েছে, শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরতে শুরু করেছে বাকিদের। কাগজে এটাও পড়লাম, দেশের সংবাদপত্র মালিকদের বৃহত্তম গোষ্ঠী ইন্ডিয়ান নিউজ পেপার সোসাইটি (আই এন এস, কম বেশি প্রায় হাজার খানেক সংবাদপত্র যার সদস্য) পিঠ বাঁচাতে এ বার সানুনয় ভিক্ষা চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে। তাদের প্রধান তিনটি আর্জি হল সাময়িক ভাবে কর মকুব করা, বিদেশি নিউজপ্রিন্টের আমদানির ওপরে যে পাঁচ শতাংশ অন্তঃশুল্ক চাপানো আছে সেটা তুলে দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারি বিজ্ঞাপনের হার অন্তত ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা। কাগজের মালিকদের লবির কব্জির জোর আছে, তাদের নিবেদন একেবারে ব্যর্থ হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া যে কোনও শাসকই চায় মিডিয়ার সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। ভিক্ষাপাত্র হাতে তাবড় তাবড় মিডিয়া মোগল সামনে এসে দাঁড়ালে শাসকের যে কী অনির্বচনীয় আনন্দ হয় তা চাক্ষুষ করার দুর্ভাগ্য আমার নিজেরই বেশ কয়েকবার হয়েছে।
বড় মাছ তবু ভেসে থাকবে, মাঝারি অথবা ছোটদের হবেটা কী? বাংলার মিডিয়ার নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখি বলে তাদের নিয়েই আমার প্রবল দুশ্চিন্তা। সরকারি আনুকূল্য না পেলে বেশিরভাগ বাংলা কাগজ আগামীকালই দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হবে। মহা-মন্দা এলে সরকারের প্রচারের বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট হতে বাধ্য। অন্যদিকে বে-সরকারি বিজ্ঞাপনেও খরা। তাহলে? স্রেফ মালিকদের দোষ দিয়ে বিপ্লবীয়ানা দেখানোর কোনও মানে হয় না। আয়ের রাস্তাগুলো একে একে যদি বন্ধ অথবা সঙ্কুচিত হতে শুরু করে মালিকরাই বা সেক্ষেত্রে করবেনটা কী? সামনে অতএব গভীর, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। করোনা না হয়েও কত লোক যে ভাতে মারা পড়বে ভাবলে আমার মতো ঝরাপাতারও বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠছে।
(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

