- August 13th, 2022
পঁচাত্তর বনাম একশো
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আনন্দবাজারের কর্মচারীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নিজেদের অনেক ছবি পোস্ট করেছেন। বেশ করেছেন, এখন তো আনন্দ হি কেবলম। অনেক মুখ দেখলাম, ছেলেদের বেশি, মেয়েরা যেন পার্সিদের মতো সংখ্যালঘু। সব কিছু ভালো লাগল, ছেলেদের ওই টকটকে লাল ধুতি আর গোলাপি ফুল-কাটা পাঞ্জাবি ছাড়া। কেউ কিছু মনে করলে করবেন, এই সঙের পোশাক আনন্দবাজারের অভিজাত সংস্কৃতির পরিপন্থী। বাঙালি প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষে বঙ্গসন্তানেরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরবেন তো বটেই কিন্তু তাই বলে কি মাড়োয়ারি বিয়ের সাজ পরতে হবে তাদের? বোঝাই গেল এর পিছনে পরিকল্পনা ছিল, হয়তো কোনও ড্রেস-ডিজাইনার ছেলেদের এমন বিচিত্র ইউনিফর্ম সুপারিশ করেছেন, কিন্তু তাতে কী? সুপারিশ ভিটো করার ক্ষমতা তো কর্তৃপক্ষের ছিল, তাঁরা সেটা প্রয়োগ করলেন না কেন?
অনেকগুলো মুখ দেখলাম, একজনকেও চিনতে পারলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম আমি চলে আসার পরে গত ১৮ বছরে ৬ নম্বর প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের শ্বেত-শুভ্র ইমারতটি বহিরঙ্গে একই রকম দেখালেও ভিতরটা এক্কেবারে পাল্টে গিয়েছে, মঞ্চে যাঁরা এলেন তাঁদের মধ্যে কয়েক জনকে অবশ্য চেনা গেল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অথবা অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা যথাযথ, কিন্তু শকুনি মামা এঁদের সঙ্গে একই বন্ধনীতে কী করে আসতে পারেন বোধগম্য হল না। বোঝা গেল হাত কচলানো পুরাতন ভৃত্যের আনুগত্যও এখন আনন্দবাজারে সংবর্ধনার মানদণ্ড বলে বিবেচিত হয়, যেটা অভীক সরকারের আমলে অকল্পনীয় ছিল। ইতরকে সম্মান জানালে যে গুণীজনকে অসম্মান করা হয় সেই বোধটাই সরকার বাড়িতে কারও নেই।
না, আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম না। তেমন প্রত্যাশাও ছিল না ছিটোফোঁটা। যাঁদের কাছে অভীক সরকার পার্সোনা নন গ্রাটা, তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান যেখানে স্বীকৃত হয় না সেই সব যোগী আদিত্যনাথদের কাছে আমি তো পোকা-মাকড়। অভীকবাবু নিমন্ত্রিত ছিলেন কি না জানতে পারিনি, যেমন জানতে পারিনি নিমন্ত্রণ পেয়েও অনুষ্ঠানটি এড়িয়ে গেছেন কি না। অভীকবাবু না থাকার অর্থ, হ্যামলেট মঞ্চস্থ হচ্ছে ডেনমার্কের রাজপুত্রকে ছাড়াই। গোটা অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় চমকটি ছিল অমর্ত্য সেনের সংক্ষিপ্ত লিখিত ভাষণ, বিদেশে মনোরম সবুজ পরিবেশের প্রেক্ষাপটে চেয়ারে বসে বাংলায় তিনি যেটি পাঠ করলেন। আনন্দবাজার ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ইংলিশম্যান পত্রিকায় কী লেখা হয়েছিল অমর্ত্যবাবু তা একাধিকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। লাল কালিতে ছাপা হওয়া সদ্যোজাতর মধ্যে বিপদের সঙ্কেত দেখতে পেয়েছিল ইংলিশম্যান।
শতবর্ষ পরে আর কেউ কি আনন্দবাজারকে ভয় পায়? নাকি আনন্দবাজার গোষ্ঠীই ভয় পায় শাসককে? কিংবা বাঙালির এই গর্বের প্রতিষ্ঠানটিকে পাঠক কী আর সম্ভ্রমের চোখে দেখে? আমি যতদূর জানি আতঙ্ক এখন কেবল কর্মচারীদের চোখে-মুখে। কোম্পানির এইচআর থেকে কখন টেলিফোন আসে, কখন চাকরিটা নট হয়ে যাবে কেউ তা জানে না। বাবুদের জন্য আনন্দবাজার মহীরুহের চেহারা নেয়নি, নিয়েছে সাংবাদিক-অসাংবাদিক কর্মীবৃন্দের জন্য। তারাই আজ এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে অবহেলিত ও অবদমিত, যত আতঙ্ক এখন তাদেরই।
শতবর্ষ উদযাপন দেখলাম না তবে ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান দেখেছি। শতবর্ষে মঞ্চ আলো করে বসেছিলেন তিন ফেসলেস কর্মচারী। পঁচিশ বছর আগে এসেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরাল আর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও। গুজরালের সঙ্গে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পরিচয় অনেক দিনের আর অভীকবাবু ছিলেন মস্ত রাও ভক্ত। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে জওহরলাল নেহরু নয় নরসিংহ রাওকেই অভীকবাবু শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী বলে মনে করতেন। প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে পেঙ্গুইন থান ইটের মতো মোটা রাওয়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি ছেপেছিল। সম্ভবত নামটা ছিল দ্য ইনসাইডার।
সেই উপলক্ষ্যে গোষ্ঠীর মুখ্য সম্পাদক হিসেবে অভীকবাবু যে ভাষণটি পাঠ করেছিলেন তার প্রস্তুতিতে আমার কিঞ্চিৎ অবদান ছিল। সেদিন তিনি সেহবাগের ঢঙে ব্যাটিং করেছিলেন, একটা বলও তাঁর ব্যাটে লেগে মাঠের ভিতরে পড়েনি। অনেকের মনে হয়েছিল অভীক সরকার উদ্ধত, আত্মম্ভরিতা সর্বস্ব একজন মানুষ। তবে সেটাই ছিল অভীকবাবুর ট্রেডমার্ক। সচেতন ভাবে শ্রোতাদের হতচকিত করে দিতে তিনি ভালোবাসতেন। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সম্পাদকের ভাষণ মানে কারও না কারও মাথায় হাতুড়ির বাড়ি।
অতি সংক্ষেপে সেদিন অভীকবাবু আনন্দবাজারের ইতিহাসের ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন তাতে কিন্তু ছিটেফোঁটাও অতিরঞ্জন ছিল না। তিনি বলেছিলেন, আনন্দবাজার গোড়ার দিকে সুভাষ চন্দ্র বসুকে সমর্থন করত না, গান্ধীজিকে করত। মানে আনন্দবাজার ছিল ষোলো আনা গান্ধীবাদী সংবাদপত্র। কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও গান্ধীর মন্ত্রণায় তিনি যখন ওয়ার্কিং কমিটি গড়তে পারলেন না, ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন সেদিন থেকে আনন্দবাজারের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। আনন্দবাজার হল সুভাষপন্থী, আনন্দবাজার হয়ে দাঁড়াল ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’।
অভীকবাবু সুলভ দাদাগিরি ছিল ভাষণের অন্যত্র, যখন তিনি বললেন, “লোকে আমাকে প্রায়শই জিজ্ঞেস করে আমরা জ্যোতি বসুর সমর্থক না বিরোধী? আমরা কি কংগ্রেসের পক্ষে না বিপক্ষে? তাঁদের আমি সবিনয়ে বলতে চাই, আজ আনন্দবাজার এমন দুর্লঙ্ঘ উচ্চতায় পৌঁছেছে যে তার আর কোনও রাজনৈতিক দলের উপগ্রহ হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। তবে সিপিএম অথবা কংগ্রেস ইচ্ছে করলে আনন্দবাজারের উপগ্রহ হতে পারে।’ সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে প্রথম সারিতে বসে ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস, তাঁর পাশের আসনেই আমি। অভীকবাবুর কথা শুনে আমরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলাম একটু মুচকি হেসে।
তবে কর্মচারীদের মজা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিজেদের একটি মধ্যাহ্নভোজনের অনুষ্ঠানে। সল্টলেক স্টেডিয়ামের দৌড়োনোর ট্র্যাকে লাইন দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে সোনার মুদ্রা স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তারপর গ্যালারিতে ১২০০ জন এক সঙ্গে বসে পাত পেড়ে খাওয়া। একহাত লম্বা গলদা চিংড়ির মালাইকারি, যত ইচ্ছে খাও। এটাই ছিল আনন্দবাজারের আত্মা, দ্য স্পিরিট অব ওয়াননেস। আনন্দবাজারে যারা কাজ করত তারা কেউ অফিসটাকে কর্মস্থল বলে মনে করত না। সেটাই ছিল তাদের সব হতে আপন শান্তিনিকেতন। কাগজে কলমে কর্মী, আসলে তারা সীমান্তে মোতায়েন সৈনিক। আমি একদা সেই আনন্দবাজারের অংশ ছিলাম ভাবলে গর্ব হয়। ঠিক তেমনি মন খারাপ লাগে যখন দেখি প্রতিষ্ঠানটি আজ দুরারোগ্য ক্ষয় রোগে আক্রান্ত।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

