- August 13th, 2022
একলা একটা চেয়ার
সুকল্প চট্টোপাধ্যায়
‘কলকাতা শহরটা তখন একটা অন্য শহর ছিল। কিছু হতে হবে বলে কেউ কিছু করত না। কবিরা কবিতা লিখত তার পর ঘুমিয়ে পড়ত, ছবি-আঁকিয়েরা রঙের সঙ্গে রাজনীতি গুলত না, ধান্দাবাজেরা তখনও এই শহরটাকে মুঠোর ভিতর নিয়ে নেয়নি। প্রেম না পেয়ে দাড়ি রেখে হারিয়ে গিয়েছে অনেক যুবক, অ্যাসিডের বোতল দোকানেই থেকে গিয়েছে ঠিকঠাক কাজে ব্যবহারের জন্য। এত রাগ এই শহরটার গলা পর্যন্ত উঠে আসেনি তখনও।’
আসলে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর একটা প্রার্থিত বাস্তব ছিল। বছর ছয়েক আগের সেই লেখায় তেমনই এক কলকাতাকে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এই বাস্তবকে দেখার ইচ্ছে বা চোখ সব শিল্পীর থাকে না, তাঁর ছিল। তাই বাইরে যা ঘটছে তাকে ভিতরের রান্নাঘরে এনে স্বপ্ন দিয়ে ছায়া দিয়ে গভীর মায়ায় রাঁধতেন তিনি। বাস্তবকে নিজের অবচেতনের আঙুলে সুতোয় বেঁধে ঘোরানোর স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। তাই তাঁর কবিতা আর সেলুলয়েডের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার কোনও ইচ্ছেই পাঠক বা দর্শকের জাগে না। কবি রাণা রায়চৌধুরীকে বলতে হয়, ‘চরাচর দেখে/ যখন বেরিয়ে এলাম তখন/ আমার/ গা ভর্তি পাখি’।
আর পাঁচটা বাঙালি রসগ্রাহীর মতোই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসা শুরু কৈশোর থেকেই। আর ব্যক্তিগত আলাপ খুবই স্বল্প দিনের, তাও দূরাভাষেই। সেই আলাপের ভিত্তি অবশ্যই একটি বই। তাঁর নিকটজন কবি কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যর উৎসাহে এবং অবশ্যই আমাদের প্রবল আগ্রহে আজকাল প্রকাশনের দপ্তরে এসে পৌঁছয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। সেই পাণ্ডুলিপি সাজিয়ে দিয়েছেন তাঁর আরএক সুহৃদ কবি অরণি বসু। সেই সূত্রেই বারবার ফোনালাপ। প্রথম দিন সন্ধ্যায় শুরুতেই বিচিত্রালাপ। ‘আমার কবিতার পাণ্ডুলিপি সুকল্প নামের কারওর হাতে গিয়ে পড়বে এমনটা আমি ভাবিনি’। হাসি ছাড়া আর কী-ই বা উত্তর দিই। উনি বললেন, না না, সত্যিকথা আমি এই সব ভাবি। মানে যার হাতে গিয়ে পড়বে তার নাম কী হতে পারে। সত্যিই এই নামটা ভাবিনি।
কবিতা কম্পোজ হচ্ছে। পড়ছি আশ্চর্য সব লেখা।
পরের জন্মে…
পরের জন্মে যদি আর মানুষ হয়ে না জন্মাই
যদি একটা গাছ হয়ে জন্মাই
বা, যদি একটা মাছ হয়ে
এটা কালো মাছ হয়ে
তোমার বিছানার পাশে কাচের বোয়ামে ঘুরে বেড়াই সারা রাত আর
মাঝে মাঝে দেখেনি তোমাকে…
তুমি রোজ আমায় খাবার দিও, মাছেদের খাবার
জল বদলে দিও
তুমি কি তখন আমায় চিনতে পারবে?
বুঝতে পারবে, আসলে আমি সেই আগের একজন
তোমার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে
গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে
জলের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম।
পরের জন্মে যদি আর মানুষ হয়ে না জন্মাই
যদি একটা পাথর হয়ে জন্মাই
বা, একটা পিঁপড়ে হয়ে
তোমার পা-এর বুড়ো আঙুলের নখের ভেতর
চুপচাপ বসে থাকি আর দেখতে থাকি এই পৃথিবী
মুখ ঘুরিয়ে তাকাই তোমার দিকে
তুমি কি আমাকে চিনতে পারবে?
বুঝতে পারবে, পিঁপড়ে নয়
আসলে আমি সেই আগের একজন।
পরের জন্মে যদি আর মানুষ হয়ে না জন্মাই
যদি জন্মাই একটা শাদা পাতা হয়ে,
পাতার ভেতর কিছু অক্ষর হয়ে
আর নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে
তুমি কি অক্ষরগুলো তুলে নেবে মুঠোর ভেতর?
তুমি কি চিনতে পারবে?
বুঝতে পারবে সব কিছু?
মাঝখানে লকডাউনের জন্য দীর্ঘবিরতি। একটা সময় বাবার অসুস্থতা নিয়ে আমার জেরবার অবস্থা। এদিকে অনেক দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। জানানো হয়নি কতটা এগিয়েছে বইয়ের কাজ। তা নিয়ে মনে ভরপুর অপরাধবোধ। এমন সময় তাঁর ফোন। স্ক্রিনে নাম দেখেই ভাবছি কী ভাবে মার্জনা চাইব। হ্যালো বলতেই একের পর এক প্রশ্নবাণ। না কোনওটাই তাঁর বই নিয়ে নয়। আমার বাবা কেমন আছেন? তাঁর রোগটা কী? কোন ডাক্তার দেখছেন? যাবতীয় খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করেই চললেন। কৃষ্ণপ্রিয়দার থেকে খবর পেয়েই ফোন করছেন। যতবারই তাঁর বইয়ের প্রসঙ্গ তুলতে চেষ্টা করি, উনি আমার বাবার অসুখে ঢুকে পড়েন। ‘বড় মাপের শিল্পী হতে হলে আগে বড় মানুষ হতে হয়’। ছোটবেলায় শেখা এই কথাটার ওপর যখন মরচে পড়ে যায় বাস্তবের নানা অভিঘাতে, তখন আবার কোন সুদূর অতীত থেকে ঝিকিয়ে ওঠে প্রাচীন প্রবাদবাক্য। মানুষ বুদ্ধদেব ফিরিয়ে দেন বিশ্বাস।
শেষমেশ দু-পাতা কম পড়ছে। তাঁর একটা বা দুটো লেখা না-পেলে ফর্মা মিলছে না। তাঁকে জানাতেই গম্ভীর উত্তর, সাত দিনের ভিতর দিয়ে দিচ্ছি। সেই সাতদিন আর আসে না। প্রায় মাস অতিক্রম করতে চললো। আবার তাঁর ফোন। এবার কণ্ঠস্বর আরও গম্ভীর। আচ্ছা জয় গোস্বামী কেমন কবিতা লেখেন বলে মনে হয় আপনার?
- কেন? ভালো, খুবই ভালো। হঠাৎ এই কথা কেন? খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
- আমার থেকে বেশিই কবিতা লেখেন নিশ্চয়ই?
- তা হবে। কিন্তু কেন বুদ্ধদা?
- ভাবছি ওর থেকেই দুটো লেখা ধার নেব। আমার দু পাতা কম পড়ছে কিনা। না হলে তো আপনার আবার ফর্মায় মিলবে না।
হতবাক অবস্থা। হাসব না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফের আক্রমণ।
‘কৃষ্ণপ্রিয়র কাছে শুনেছি আপনিও লেখেন। তা আপনার কাছে দুটো লেখা ধার পাওয়া যায় না?’
সেই দু-পাতা কমই পড়ল। কখনও কখনও সবার জীবনের ফর্মা মেলানো যায় না। মেলানোর চেষ্টা করাও উচিত নয়। হয়তো দু-পাতা শূন্য রেখেই প্রকাশিত হবে জীবদ্দশায় তাঁর পরিকল্পিত শেষ কাব্যগ্রন্থ, ‘একলা একটা চেয়ার’।
বুকের ভিতর একলা একটা চেয়ারে বসেই আজীবন চিত্রকল্প বয়ন করে চলবেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

