- August 16th, 2022
বুদ্ধ ও নির্বাণ (পর্ব-৫)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ন্যূনতম ইতিহাস-চেতনা থাকলে বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায় জালিয়ানওয়ালাবাগের দৃষ্টান্ত দিতেন না। ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই কলকাতার রাজপথে পুলিশের নির্বিচার গুলি চালনা ছিল বর্বরতারই নামান্তর। তাই বলে সে দিনের ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার চেয়েও বীভৎস বলতে হবে? বলা সম্ভব? বলা উচিত?
২০১১-য় ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল ২১ জুলাইয়ের তদন্ত, ভার দেওয়া হয়েছিল ওডিশা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়কে। নির্বিকার মুখে তিনি বলে দিলেন, ‘সেদিন কলকাতায় যা হয়েছিল তা জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার চেয়েও বীভৎস ও ন্যক্কারজনক।’ মন্তব্যটি শুনে সেদিন হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারিনি। নীরবে, নিভৃতে নয়, বিচারের বাণী অনেক সময় সোল্লাসেও কাঁদে।
সে দিনের ঘটনাটি এত চর্চিত, এতদিন পরে বিশদে তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। অঘটনের পরে প্রায় তিনটি দশক কাটতে চলল, বাৎসরিক উদযাপনের কারণে ২১ জুলাই ক্যালেন্ডারের অতি-পরিচিত তারিখ। একটি জরুরি প্রশ্নের সদুত্তর কিন্তু আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সে দিন পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশটি দিয়েছিলেন কে? দিলেনই যদি তাহলে পায়ে গুলি না করে শরীর লক্ষ্য করে কেন গুলি চালানো হল? ১৩টি প্রাণ যে রাজপথেই ঝরে পড়ল, তা কি এমন হঠকারী, অমানবিক সিদ্ধান্তের জন্যই নয়?
তখন কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন তুষার তালুকদার। লালবাজারে তাঁর অফিস ঘরে কমিশনারের পিছনের দেওয়ালে লেনিনের ছবি ঝুলত, তিনি তাতে আপত্তিকর কিছু দেখতেন না। তুষারবাবু একই সঙ্গে রাহুল সংকৃত্যায়নের মগ্ন গবেষকও ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রশ্নে তিনি যে ঘোর বামপন্থী, তুষারবাবু তা লুকোবার চেষ্টা করতেন না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তিনি কেওড়াতলা শ্মশানে প্রয়াত কবিকে পুলিশের একুশটি তোপধ্বনি শুনিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন। আনন্দবাজারে আমার কলামে তুষারবাবুর এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছিলাম, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে তিনি সরকারি নিয়ম-কানুনের উপরে স্থান দিয়েছিলেন বলে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য কাদের হবে, সে সম্পর্কে সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল আছে, পুলিশ কমিশনার ইচ্ছে হল বলেই তার অন্যথা করতে পারেন না। তবে সে দিন যা ছিল ব্যতিক্রম, অনেক দিন হল তা নিয়মে পর্যবসিত হয়ে গিয়েছে। এখন কেওড়াতলায় তোপধ্বনি অদূরে কালী মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনিরই সমতুল।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই তুষারবাবু সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, তিনি গুলি চালনার আদেশ দেননি। মেয়ো রোডে গুলি চলেছে এ খবর তিনি ঘটনার পরে জানতে পারেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মণীশ গুপ্ত চট্টোপাধ্যায় কমিশনে এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি গুলি চালানোর বিরোধী ছিলেন। সে সময়ে বিভাগীয় তদন্তের ভারপ্রাপ্ত দুই অবসরপ্রাপ্ত হোমড়া-চোমড়া অফিসার জানিয়েছেন, লালবাজার কিংবা মহাকরণ কোথাও নাকি তাঁদের তদন্তের রিপোর্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ো রোডকে জালিয়ানওয়ালাবাগ বানিয়ে দেওয়া বিচারপতিও এই জরুরি প্রশ্নটির কোনও কিনারা করতে পারেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘the control room officers were vicariously responsible and liable.’ প্রকৃত লোকটিকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়ে কমিশন গোল-গোল বক্তব্য শুনিয়ে নিজের কর্তব্য সমাধা করেছিল। ‘এই দায়িত্ব যুগ্ম ভাবে পুলিশ আর স্বরাষ্ট্র দপ্তরের উপর বর্তায়। তাঁরা নিজেদের কর্তব্য পালন করলে পুলিশের গুলিতে এত জনের মৃত্যু হতো না।’ অশ্বডিম্ব প্রসবের এর চেয়ে বড় দৃষ্টান্ত কিছু হতে পারে কি?
২১ জুলাইয়ের ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই গোটা দেশের মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিল। পরের দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চহ্বন দিল্লি থেকে কলকাতায় দৌড়ে এসেছিলেন, জ্যোতিবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত করানোর জন্য। মুখ্যমন্ত্রী এই উপদেশে কর্ণপাতই করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, পুলিশ গুলি না চালালে সেদিন মহাকরণ দখল হয়ে যেত, সেটাই ছিল বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য। এই বিক্ষোভ না ছিল শান্তিপূর্ণ, না গণতান্ত্রিক। এক্কেবারে একই মত ছিল রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। চট্টোপাধ্যায় কমিশনের তলব পেয়ে বুদ্ধবাবু সেখানে বলে এসেছিলেন, বিক্ষোভকারীরা সে দিন এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে পুলিশের গুলি না-চালিয়ে কোনও উপায় ছিল না। প্রায় ৫০ মিনিটের সাক্ষ্যে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, বিক্ষোভকারীরা ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠেছিল। এতটাই যে ৭০ জন পুলিশ কর্মী কম-বেশি আহত হয়েছিলেন।
বিচারপতি চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা গুগলিতে কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করেন বুদ্ধবাবু। বিচারপতি জানতে চান, ‘এতজন পুলিশ কর্মী যদি সত্যিই আহত হয়ে থাকেন তাহলে তাঁরা চিকিৎসার জন্য গেলেন কোথায়? কোনও হাসপাতালের রেকর্ডে তো এই তথ্য প্রতিফলিত হচ্ছে না?’
বিচারপতি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ফের প্রশ্ন করেন, ‘কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর কি পুলিশের এ ভাবে গুলি চালানো উচিত?’
বুদ্ধবাবু — গণতান্ত্রিক আর সিউডো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে অনেক তফাৎ। এই আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল যেন তেন প্রকারেণ মহাকরণ দখল করা।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত করালেন না কেন?
বুদ্ধবাবু — তখনই অনেক ভাবনা চিন্তা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিচার বিভাগীয় তদন্তের কোনও প্রয়োজন নেই। আজও আমার সেটাই মত।
এহ বাহ্য! উপর্যুপরি ঘটনায় এমন অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁরা যে খাল কেটে কুমির ডাকছেন, প্রশস্ত করে দিচ্ছেন রাজ্যে বাম-বিরোধী রাজনীতির পরিসর, তৈরি করে দিচ্ছেন একজন বিরোধী নেত্রীর প্রতিবাদের মঞ্চ, এই চেতনাটাই তখন বুদ্ধবাবুদের ছিল না। তার বছর দুয়েক আগেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতায় ফিরেছে বামফ্রন্ট, কার সাধ্য আছে এই অশ্বমেধের ঘোড়াকে আটকায়?
গণতন্ত্রে কোনও দলের ব্রুট মেজরিটি এই কারণেই বিপজ্জনক। যত বেশি আসন তত বেশি আস্ফালন, তত বেশি অহং, তত বেশি স্বেচ্ছাচার, গল্পের শেষে নিরন্ধ্র, নির্মম পতন। মুশকিল হল ইতিহাসের এই জরুরি শিক্ষাটা শাসকের প্রায়শই মনে থাকে না। (চলবে)
(ছবি ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

