- August 13th, 2022
যাব যাব করেও সুভাষ থেকে গেলেন
যাব যাব করেও সুভাষ থেকে গেলেন
সুমন চট্টোপাধ্যায়
(ভোট চলছে বঙ্গে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁদের সরব উপস্থিতি ব্যতিরেকে বঙ্গে ভোট-রঙ্গের কথা ভাবাই যেত না। তাঁরা নেই, আবার আছেনও, আমার স্মৃতি ও সত্তায়। তেমনই কয়েকজন বঙ্গ-রাজনীতির মহারথীদের নিয়ে আমার এই সিরিজ। প্রথমে অনিল বিশ্বাস। দ্বিতীয় পর্ব)
হঠাৎ ফোন এল সুভাষ চক্রবর্তীর৷ ‘শোনা আজ বিকেলে পাঁচটা নাগাদ একবার পিয়ারলেস ইন হোটেলে আসতে পারবা? ভীষণ জরুরি দরকার আছে তোমার সঙ্গে৷’ বিশুদ্ধ ঢাকাইয়া উচ্চারণ৷
সিপিএমের সব নেতা-নেত্রীর মধ্যে আমার সবচেয়ে ফেভারিট ছিলেন অবশ্যই সুভাষবাবু৷ দিলখোলা, পরোপকারী, প্রাণবন্ত এবং আপাদমস্তক বাস্তববাদী মানুষ৷ মানুষকে বিশ্বাস করতেন সহজে আর একবার বিশ্বাস করলে রেখে-ঢেকে কথা বলতেন না৷ মোদ্দা কথায় আগ মার্কা কমিউনিস্ট বলতে যা বোঝাত, সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন এক্কেবারে তার বিপরীত৷ রসিকতা করে আমি বলতাম, ‘ইউ আর দ্য রাইট ম্যান ইন দ্য রং পার্টি৷’
তার আগে অনেকবার অনেক জায়গায় কথা হয়েছে সুভাষবাবুর সঙ্গে, তাঁকে নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও করেছি, কিন্তু কোনো দিন তাঁর কাছ থেকে এমন জরুরি তলব পাইনি৷
২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা৷
নির্দিষ্ট সময়ে হোটেলের ঘরে পৌঁছে দেখি সুভাষবাবু যথারীতি বেশ কয়েকজন চামচে পরিবৃত হয়ে বসে আছেন, মাথার পানামা হ্যাটটি সোফার সামনের টেবিলের ওপর রাখা৷ আমি ঢোকা মাত্র তিনি পারিষদদের অল ক্লিয়ার সঙ্কেত দিলেন হাত নেড়ে৷ দরজা বন্ধ হতেই ফিসফিস করে বলতে শুরু করলেন, ‘শোনা আমি এ বার জোরে নাড়া দেব বলে ঠিক করে ফেলেছি৷ তোমাদের সাহায্য চাই৷’
বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারলাম না তাঁর কথা৷ ‘নাড়া দেবেন মানে? কাকে? কেন? কখন?’
‘আরে বাবা আমি পার্টি ছাড়ত্যাসি৷ অনেক হয়েছে আর নয়৷’
পরের দিনের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটি হঠাৎ ভেসে উঠল চোখের সামনে৷ আট কলম ব্যানার হবে খবরটা৷ উত্তেজনায় মনে হল শরীরের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে উঠছে৷ ‘দেখবেন এই খবরটা আবার অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন না যেন৷’
তার পরেই অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স৷ আমার হাত জড়িয়ে ধরে এ বার সুভাষবাবুর অনুরোধ, ‘খর্বদার এখন লিখবা না৷ যেদিন পার্টি ছাড়ব তার আগের দিন তোমারে কইয়া দিব, কথা দিত্যাসি৷’
খবরই যখন করতে দেবেন না তখন এস ও এস দিয়ে আমাকে কেন ডেকে পাঠালেন বুঝতে পারলাম না৷ তারপরে সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে যে সংক্ষিপ্ত কথা-বার্তা হল তা থেকে বুঝতে পারলাম তিনি দলের ওপর বেজায় রেগে গেলেও দল ছাড়বেনই এমনটা তখনও মনস্থ করতে পারেননি৷ কেননা জ্যোতিবাবু স্বয়ং তাঁকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছেন দলত্যাগ না করার৷
ওঠার আগে তাই বাজি ধরে এলাম সুভাষবাবুর সঙ্গে৷ ‘আমি এখনই বলে দিচ্ছি, আপনার আর দলছাড়া হবে না৷ অন্তত জ্যোতিবাবু যদ্দিন বেঁচে আছেন৷’
সেই মুহূর্তে জোরে জোরে মাথা নেড়ে তাঁর প্রত্যয়ের কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত বাজিতে আমিই জিতেছিলাম৷ ২০০১-র বিধানসভা ভোটে সিপিএমের প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হওয়ার দিন বাড়িতে টেলিফোন করে সুভাষবাবুকে ঠেস দিয়ে বলেছিলাম, ‘কাস্তে-হাতুড়ি-তারা কি আপনার নতুন দলেরও প্রতীক?’
তার মানে ১৯৯৮ সালে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই অনিল বিশ্বাসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা ছিল দলে বড়-সড়ো ভাঙন রোধ করা৷ অন্তরালের সেই কাহিনি ছিল খুবই রোমাঞ্চকর৷
দল ভাঙার প্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সফি দা, মানে সৈফুদ্দিন চৌধুরী, কয়েক বছর আগে ক্যান্সারের কাছে যাঁকে হার মানতে হয়েছে৷ দলের অন্দরে তিনি যে প্রাসঙ্গিক তাত্ত্বিক বিতর্কটি শুরু করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ধীরে ধীরে তার সমর্থনেই সিপিএমের অন্দরে বিক্ষুব্ধ নেতারা একজোট হতে শুরু করেন৷ শেষ পর্যন্ত দল বড় রকম ভাঙন এড়াতে পারলেও সেই বিতর্কের রেশ সিপিএমে এখনও থেকে গিয়েছে৷
আশির দশকে দিল্লির সংসদে সিপিএমের উঠতি নেতাদের মধ্যে সৈফুদ্দিন চৌধুরীই সকলের নজর কেড়েছিলেন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে৷ আপাদমস্তক সজ্জন এই যুবা-নেতা ছিলেন সকলের প্রিয়পাত্র, এমনকী বিরোধীদেরও৷ সে সময় লোকসভায় ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, গীতা মুখোপাধ্যায় বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাগ্মিরা বসতেন বিরোধী বেঞ্চে৷ তাঁদের মধ্যে থেকেই বক্তা এবং তার্কিক হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি৷ সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতীয় লবি অখ্যাত কাটোয়া থেকে বারেবারে নির্বাচিত হয়ে আসা এই সম্ভাবনাময় নেতার স্বীকৃতি, জনপ্রিয়তা কিংবা নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে তাত্ত্বিক বিতর্ক করার ক্ষমতা হজম করতে পারেনি৷ অন্যদিকে স্তালিনের শেখানো মন্ত্রে বুঁদ হয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গের কমরেডরাও সে ভাবে পাশে দাঁড়াননি তাঁর৷ সৈফুদ্দিনের বিকল্প, বাস্তবধর্মী ভাবনা চিন্তাকে কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তি আখ্যা দিয়ে তাঁর গায়ে সেঁটে দেওয়া ছিল দল বিরোধিতার লেবেল৷
সেদিন কী বক্তব্য ছিল সৈফুদ্দিন চৌধুরীর যা প্রকাশ কারাট বা সীতারাম ইয়েচুরিদের হজম হয়নি? রাম জন্মভূমি আন্দোলনের পিঠে চেপে ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি-র বিস্ময়কর উত্থানের পরে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকেই দেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করতে শুরু করেন তিনি৷ অতএব এই ‘সাম্প্রদায়িক’ শক্তিকে রুখতে কংগ্রেসকে অস্পৃশ্য জ্ঞান করার দলীয় নীতি কতটা যুক্তিযুক্ত বা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন তিনি৷ ১৯৯২-এর ডিসেম্বর মাসে নরসিংহ রাওয়ের সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় বিজেপির মতো বামপন্থীরাও অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা ভাবলে সৈফুদ্দিন তার বিরোধিতা করেন সর্বশক্তি দিয়ে৷ তখন তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, রাওয়ের সংখ্যালঘু কংগ্রেসি সরকারের পতন ঘটলে বামেদের বাড়তি লাভ কিছু হবে না কিন্তু বিজেপি তার ফায়দা তুলবে পুরোদমে৷ রাওয়ের সরকার সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও দল তাঁকে রেয়াত করেনি৷ তার তিন বছর পরে ১৯৯৫ সালের চণ্ডীগড় কংগ্রেসে হঠাৎ দেখা গেল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে সৈফুদ্দিন চৌধুরীকে৷ পরের বছরের লোকসভা ভোটে তাঁকে আর দলের টিকিট দেওয়া হল না৷
তিনি সত্যিই কংগ্রেসের কত বড় চামচা নানা সময়ে এই প্রশ্ন করে খোঁচা দিয়েছি সফিদাকে৷ যতবার প্রশ্নটি শুনেছেন ততবার হে হে করে হেসে উঠেছেন এবং ততবারই জবাবে বলেছেন একই কথা৷ ‘কী আর বলব বল, এর চেয়ে বড় সত্যের অপলাপ আর কিছু হতে পারে কি? কংগ্রেস-পন্থী বা কংগ্রেস বিরোধী আমার কোনোটাই হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ বাহাত্তরে কংগ্রেসি গুন্ডারাই আমাকে কাটোয়ায় ঘরছাড়া করে দিয়েছিল৷ আমার গ্রামের বাড়িতে অনেকবারই তারা হানা দিয়েছে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে উত্তমমধ্যম দেবে বলে৷ দলের কত কমরেডকে চোখের সামনে আক্রান্ত হতে দেখেছি, মরতেও দেখেছি৷ কংগ্রেস যদি উত্তরোত্তর দুর্বল হয় আর সেই শূন্যস্থানে বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে বামেদের উত্থান হতে থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা৷ কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কী? ফলে এখানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন৷ এমন যদি কোনো বিকল্প রাজনৈতিক মঞ্চ থাকত যেটা কংগ্রেস বা বিজেপি-র মতো সমান শক্তিশালী তাহলে আমি তার পক্ষেই থাকব৷ কিন্তু সেটা যখন নেই তখন চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে রুখতে আমাকে কিছুটা নমনীয় হতেই হবে৷ কার নাম শুনলে আমার গায়ে অ্যালার্জি হয় সেটা মনে রাখলে চলবে না৷’
দলীয় নীতি বা কৌশলের প্রশ্নে মতপার্থক্যই শুধু নয়, সৈফুদ্দিনের মূল অভিযোগটা ছিল সিপিএমের অন্দরে বিরুদ্ধ মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রটাই একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে৷ বিরুদ্ধ মত সম্পর্কে সহনশীলতা তো দূরস্থান কেউ বিকল্প কিছু ভাবার বা বলার চেষ্টা করলেই তাঁর টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা হচ্ছে৷ আজ আমার ইচ্ছে হল আমি তোমায় কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দিলাম, কোনও কারণ দর্শানোর প্রয়োজনও বোধ করলাম না, এটা তো সুস্থ গণতন্ত্র নয়৷ মোদ্দা কথায় সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার নির্মম পতন থেকে শিক্ষা নিয়ে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং চিন্তাধারায় যুগোপযোগী বদলের দাবিই তিনি করেছিলেন বারবার৷ কারণ সৈফুদ্দিন বিশ্বাস করতেন, ‘দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টির পতনের প্রধান শিক্ষাটি হল খাদ্য আর বাসস্থান জু্গিয়েই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো যায় না৷ কেননা মানুষ ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়,সমাজে বহুত্ববাদ চায়, এবং এমন একটা পরিবেশ চায় যেখানে সে নির্ভয়ে মনের ইচ্ছে ব্যক্ত করতে পারে৷’
তার সামান্য কিছুকাল আগেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভ-বিরোধী সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে যে দল প্রকাশ্যে উৎসব করেছিল সেখানে প্রত্যাশিত ভাবেই খোলা হাওয়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল৷ সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কিংবা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখলের ছেলেমানুষি হুঙ্কার বন্ধ করতে তখনও প্রস্তুত ছিল না সিপিএম৷ সেখানে সৈফুদ্দিনের অবস্থানটি ছিল তাসের দেশের রাজপুত্রের মতো৷ রাজপুত্রের ছোঁয়ায় চিড়েতন-হরতন-ইস্কাবনদের হৃদয়ে তবু দোলা লেগেছিল, মহামতি স্তালিনের ভক্তকুল ছিলেন নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু৷
সৈফুদ্দিনের তোলা এই বিতর্কটাই ভিন্ন প্রেক্ষিতে ফের নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছিল ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে জ্যোতি বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না সেই প্রশ্নে৷ সৈফুদ্দিন সে সময় আর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন না, ফলে দলের মঞ্চে নিজের মতামত জানানোর কোনো সুযোগ তিনি আর পাননি৷ কিন্তু সেই বিতর্কে অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু, নিরুপম সেন সকলেই ছিলেন জ্যোতিবাবুর বিপক্ষে৷ পক্ষে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ সে সময় সৈফুদ্দিনের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল বুদ্ধদেববাবুর, দলীয় বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি এলে তিনি এই কমরেডের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতেন নিয়মিত৷ তার মানে সৈফুদ্দিন সে সময় যে প্রশ্নগুলি তুলেছিলেন দলের কট্টরপন্থীদের কাছে তা অপাংক্তেয় ঠেকলেও তার বৈধতা কিংবা প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বোধহয় বুদ্ধদেববাবুর মনেও কোনও সংশয় ছিল না৷ যদিও নীরব সমর্থনের উর্ধ্বে তিনি আর উঠতে চাননি৷
তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভিটো দেওয়াটা জ্যোতিবাবু কোনও দিন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি, দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে বারেবারে তাঁর ঊষ্মা প্রকাশ করে গিয়েছেন প্রকাশ্যেই৷ অথচ মজার ব্যাপার হল, অনিল বিশ্বাসের বিরোধিতাকে সহজ মনে মেনে নিতে পারলেও বিমান বসুর বিরোধিতাকে তিনি সে ভাবে মেনে নিতে পারেননি৷ তার একটা কারণ ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সিদ্ধান্তের পরে দলের অন্দরে বিমানবাবু হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতিবাবুর কট্টর সমালোচক৷ সেই সমালোচনা ছিল যতটা কর্কশ প্রায় ততটাই উচ্চগ্রামের৷ ফলে অচিরে, ১৯৯৮ সালে যখন রাজ্যে নতুন সম্পাদক নির্বাচনের প্রশ্নটি এল অনিল বিশ্বাসের পক্ষ নিয়ে জ্যোতিবাবু রুখে দিলেন বিমান বসুকে৷ তাঁর যুক্তিটিও ছিল অকাট্য৷ অনিলের ঠান্ডা মাথা, সব দিক ভেবে চিন্তে কাজ করতে পারে, বিমান তা পারবে না৷ ফলে অনিলবাবু রাজ্য সংগঠনের হাল ধরার পরে দেখা গেল বিমান বসু দলীয় কাজের চেয়ে রাজ্যে সাক্ষরতা প্রসারেই বেশি মনযোগী হয়ে পড়েছেন৷ চাণক্য অনিল বিশ্বাস সে দিকেই অগ্রজকে ঠেলে দিয়ে দলের ভিতরে নিজের পথটা মসৃণ করতে চেয়েছিলেন কি না তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে৷
সৈফুদ্দিন আর সে ভাবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন না ঠিকই, কিন্তু বিক্ষোভের আগুন দলের অন্দরে ধিক ধিক করে জ্বলছিলই৷ সেই কারণেই বোধহয় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে যে ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, সৈফুদ্দিনের ক্ষেত্রে সেই কাজটি করতে পারেনি সিপিএম৷ না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরে সৈফুদ্দিন নিজেই দলের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সম্মানজনক বিচ্ছেদের৷ বিচক্ষণ অনিল বিশ্বাস তিক্ততা বাড়ানোর আর কোনও সুযোগ না দিয়ে সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন৷ তাঁরই উদ্যোগে এ ব্যাপারে রাজ্য কমিটির সর্বসম্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় কমিটি মেনে নিয়েছিল৷ ২০০০ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিল দলের সদস্যপদের তালিকা থেকে সৈফুদ্দিন চৌধুরীর নামটি বাদ দেওয়ার৷ সৈফুদ্দিনই বোধহয় সিপিএমে প্রথম ব্যক্তি দল যাঁকে দল-বিরোধী আখ্যা দিলেও শেষ পর্যন্ত বহিষ্কার করার মতো চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি৷ বিদায়ের লগ্নেও এইভাবে তাঁর ও তাঁর বক্তব্যের গুরুত্বের স্বীকৃতি সৈফুদ্দিন আদায় করে নিয়েছিলেন৷
কিঞ্চিৎ বিস্মিত আমি তার অব্যবহিত পরেই অনিলবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম সৈফুদ্দিনের ক্ষেত্রে তাঁদের নমনীয় মনোভাব নেওয়ার কারণটি কী৷ সতর্ক রাজ্য সম্পাদক পরিষ্কার সদুত্তর এড়িয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত ঠারেঠোরে যেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তা হল সৈফুদ্দিন সম্পর্কে রাজ্য সিপিএমে অনেকেরই বিশেষ দুর্বলতা আছে৷ তাঁর তোলা ইস্যুগুলির সঙ্গেও অনেকে একমত৷ অতএব বিধানসভা ভোটের সামান্য কয়েক মাস আগে সেই সহানুভূতি তিনি উস্কে দিতে যাবেন কেন? যে ব্যক্তি নিজেই বিদায় নিতে চাইছেন তাকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার কী প্রয়োজন?
দলের সঙ্গে সৈফুদ্দিনের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদে মনোমালিন্য আর মতবিরোধের একটা পর্ব মিটলেও রাজ্য সিপিএমের অন্দরে ক্ষোভ জমাট বাঁধছিলই৷ এর পিছনে পরোক্ষ সমর্থন ছিল জ্যোতিবাবুরও৷ তিনিও চাইছিলেন দলের ভিতরে বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক চলুক৷ যদিও দল ভাঙার প্রস্তাবকে তিনি কোনও দিনই সমর্থন করেননি৷ ফলে সঙ্কটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনিল বিশ্বাস আবার পেলেন জ্যোতিবাবুর সক্রিয় সহযোগিতা৷ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে তিনি আটকে দিলেন সুভাষ চক্রবর্তীকে৷ দলে ভাঙন হল বটে তবে সুভাষবাবু নেতৃত্ব দিলে ভোটের মুখে সিপিএমকে যে বাড়তি উদ্বেগের মধ্যে পড়তে হত সেটা আর হল না৷ সৈফুদ্দিন দল গড়লেন, সমীর পুততুণ্ডর মতো কয়েক জন কমরেডকে সঙ্গেও পেলেন কিন্তু ভোটে আর হালে পানি পেলেন না৷ শেষ হাসিটি ফের হাসলেন অনিল বিশ্বাস৷


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

