- August 16th, 2022
ক্ষুরের দাগ গালে থেকেই যায়
সুমন চট্টোপাধ্যায়
টেলিফোনের ওপারের গলাটা চিনতে পারছি, কার গলা ঠিক বুঝতে পারছি না। ফুটো তবলার মতো ফ্যাসফেসে আর দারুন উত্তেজিত।
‘শুনুন আপনার মতো দু’পয়সার রিপোর্টার আমি বহুৎ দেখেছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনার মালিককে বলে চাকরিটা খেয়ে নেব।’
‘নেবেন’
‘রাস্তাঘাটে কোনও দিন ক্ষুর খেয়ে যেতে পারেন। জানেন তো গালে ক্ষুর খেলে সেই দাগ আর ওঠে না।’
বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো সংলাপ কিছুক্ষণ মুখ বুজে সহ্য করার পরে আমায় বলতেই হল, ‘আপনি কি আমায় চমকানোর চেষ্টা করছেন? ভুল লোককে ফোন করেছেন তাহলে।’
আমার সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথোপকথন। ১৯৮৫। আমি তখন সবে দিল্লি বদলি হয়েছি। সাড়ে তিন দশক আগের কথা।
মা যা হয়েছেন দেখে বোঝার উপায় নেই মা একদা কেমন ছিলেন। পরবর্তীকালে বয়স এবং তৃণমূল কংগ্রেসে জবুথবু হয়ে থাকার কারণে সুব্রতবাবু অনেক বদলে গিয়েছিলেন, অনেক স্তিমিত, এক্কেবারে যেন ভেজা বারুদ। কিন্তু পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে? আমার সঙ্গে তাঁর উপরোক্ত কথোপকথনকে সামান্য একটি নমুনা হিসেবে ধরলে অনুমান করতে ভুল হবে না কারও।
কী আমার অপরাধ ছিল যে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সাতাশ-আঠাশ বছরের এক নিরপরাধ যুবার গালে ক্ষুর চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন? সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি, তার আগে বলে নেওয়া আবশ্যক, এমন দাদাগিরি আর মাস্তানি ছিল তাঁর রাজনীতির ট্রেড-মার্ক। তখন সুব্রত মুখোপাধ্যায় মানেই ছিল মারপিঠ আর গোলমাল। কয়েক ঘণ্টার জন্য তিনি ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে পুলিশের কালো গাড়িতে উঠতেন, সন্ধ্যা নামার আগেই হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে আসতেন। ভাবখানা এমন যেন চিনাদের হাত থেকে তিব্বত মুক্ত করে এলেন। কংগ্রেসপন্থী খবরের কাগজগুলো তাঁকে জঙ্গি নেতার তকমা দিয়েছিল, পরে ভেবে উত্তর পাইনি, সুব্রত মুখোপাধ্যায় জঙ্গি হলে কাশ্মীরের ইয়াসিন মালিক তাহলে কী?
বিরোধী নেতা হিসেবে এটাই ছিল সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঘরানা, পরবর্তীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে তুঙ্গ-বিন্দুতে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। যখন তখন যেখানে সেখানে পথ অবরোধ, ব্যাপক ভাঙচুর, চারটে পেটো টপকে দেওয়া, পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি, কেউ বাধা দিতে এলে কিঞ্চিৎ সংঘর্ষ, এই আর কী! পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছবি-সহ সেই গন্ডগোলের একপেশে বিরাট খবর হতো, ব্যস মিশন সাকসেসফুল। এমন কাজ করো যা কাগজওয়ালার বাপও ছাপতে বাধ্য হবে।
দিল্লিতে বদলি হওয়ার আগে আমি আনন্দবাজারের রিপোর্টিং বিভাগে কাজ করেছি সামান্য দিন। কংগ্রেস বিটের রিপোর্টার কোনও কারণে অনুপস্থিত থাকলে পরিবর্ত প্লেয়ার হিসেবে আমাকে মাঠে নামানো হতো। তখন দু-চারবার আমি সুরেন ঠাকুর রোডে বিকেলবেলায় সুব্রতবাবুর প্রাত্যহিক সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিক থেকেছি। ভিড়ে ঠাসা ঘর, কিন্তু অর্থবহ কোনও আলোচনা নেই, চপ-মুড়ি সহযোগে স্রেফ গপ্পোগাছা, হাসি ঠাট্টা আর সুব্রতবাবুর বিখ্যাত সব ওয়ান লাইনার সতীর্থদের সম্পর্কে। তখন কংগ্রেসের অন্দরে সুব্রতবাবুর পয়লা নম্বর দুশমন ছিলেন সোমেন মিত্র, দুই গোষ্ঠীর মারামারি ছিল নিত্যকার ঘটনা।
পরে যখন ব্যক্তিগত সম্পর্কটা একটু আঁটসাঁট হল, আমি সুব্রতবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘এই ধরনের দিশাহীন, কর্মসূচিবিহীন, চমকসৃষ্টির রাজনীতি করে কী লাভ? এ সব করে কি আপনারা সিপিএম-কে এক ছটাক সমস্যার মধ্যেও ফেলতে পারবেন?’
সুব্রত মখোপাধ্যায়ের দুর্বোধ্য জবাবটি ছিল, ‘দেখুন আমরা বিরোধী রাজনীতি করি। আমি মনে করি আমাদের আসল কাজটা হল সরকার যা করতে চাইবে সেটারই বিরোধিতা করা, কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এ সব দেখা আমাদের কাজ নয়। কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, সিপিএম কী করত? যেন তেন প্রকারেণ রাজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, কখনও ট্রাম পুড়িয়ে, কখনও বনধ আর হরতাল করে, কখনও কারখানার ম্যানেজারকে জ্বলন্ত চুল্লিতে ছুড়ে দিয়ে, নকশাল আর কংগ্রেসিদের নিকেশ করে, সব মিলিয়ে রাজ্যটায় অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।’
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন সিপিএমের দেখানো পথই আপনাদেরও পথ?
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো বচনবাগিশ নেতাও প্রশ্নটি শুনে একটু থমকে যান। ‘না ঠিক তা নয়, আমি বলতে চাইছি, সরকারের বিরোধিতা করাই বিরোধীদের একমাত্র পথ। তা সেই বিরোধিতার চরিত্র যাই হোক না কেন।’
সময় গেলে এমন আগুন-খোর সিপিএম বিরোধী নেতাও একদিন সিপিএম-বান্ধব হয়ে গেলেন। তাঁর জন্যই বাংলার রাজনৈতিক অভিধানে উঠে এল একটি নতুন শব্দ, ‘তরমুজ’।
(চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

