- August 16th, 2022
পোস্ট কেন তুলে নিলাম
সুমন চট্টোপাধ্যায়
গতকাল বৃহস্পতিবার জয় গোস্বামী ও তাঁর সাম্প্রতিকতম কবিতার বইটি নিয়ে আমার একটি ছোট নিবন্ধ এখানে পোস্ট করেছিলাম। তারপর মতামতের নামে জয়ের বিরুদ্ধে কুৎসিত সব কটূক্তি শুরু হওয়ায় বিরক্ত হয়ে আমি সেটি তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। তারপর থেকে শুরু হয়েছে আমাকে খোঁচা দেওয়ার নতুন পর্ব, বন্ধুমহল থেকেই। হোয়াটসঅ্যাপে এক বন্ধু টিপ্পনি করেছেন, ‘হাজার গালাগাল খেয়েও আপনি তো নিজের পোস্ট সরিয়ে নেন না, তাহলে এটা নিলেন কেন? কবিবর গাল খাচ্ছিল, খেত।’ আর এক বন্ধু, 'যা করেছেন, বেশ করেছেন। কবির বিপদ হলে আপনি তাঁর পাশে দাঁড়াতে যাবেন কেন, তিনি কি আপনার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন?’
তারপর থেকে নিরন্তর ভেবে চলেছি, লেখাটা সরিয়ে নিয়ে ঠিক করলাম না ভুল। ফেসবুকে বিতর্কিত কিছু লিখলে লোকে যা মুখে আসে তাই বলে গালাগাল করবে তা কি আমার অজানা ছিল? আমি নিজেই অনেক লেখা লিখে কদর্য-ভাষায় ট্রোলড হইনি কি? তাহলে আমার উচিত ছিল হয় একেবারেই লেখাটি ফেসবুকে পোস্ট না করা নতুবা একবার যখন পোস্ট করে ফেলেছি সেটা রেখে দেওয়া। সেই থেকে মনে মনে আমি একটি সদুত্তর হাতড়ে চলেছি, এখনও পাইনি। কাজটা ঠিক করলাম না ভুল।
বাম জমানায় একটি কথা প্রায়শই শোনা যেত, ‘কলাকুশলী ও বুদ্ধিজীবী’। মানে কলা-কুশলী আর বুদ্ধিজীবী দু'টি আলাদা সামাজিক গোষ্ঠী, কলাকুশলীরা বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না, ঠিক যেমন বুদ্ধিজীবীরা হতে পারেন না কলা-কুশলী। ব্যাপারটা সেই যে ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে গেল তারপর থেকে এই অর্থহীন বাংলা শব্দটি সর্বত্র সংক্রমণ ঘটিয়ে ঘোর অনর্থ বাধিয়ে চলেছে তো চলেছেই। বুদ্ধি কারও জীবিকা হতে পারে না, ইংরেজি ‘ইনটেলেকচুয়াল’ শব্দটির অর্থ একেবারেই অন্য। সেখানেও আবার ইনটেলেকচুয়ালের বিবিধ সংজ্ঞা দেওয়া আছে। আমি যখন আনন্দবাজারে ছিলাম, কোম্পানি বাহাদুর ফতোয়া জারি করে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, সঙ্গত কারণেই। আনন্দবাজার নিষিদ্ধ করেছে বলে জনতার দরবারে তা স্বীকৃত হয়েছে বা হতে পারে এমন সম্ভাবনাও দেখি না। লোকে এখনও নির্বিচারে যাকে পারে তার গায়েই বুদ্ধিজীবীর তকমা এঁটে দেয়, বাছ-বিচারের ধার ধারে না। বোধ-বুদ্ধিহীনদের কাছে অর্থহীন এই বাংলা শব্দটি মান্যতা পেয়েই চলেছে।
কে ইনটেলেকচুয়াল আর কে নয়, সেই তর্কে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, যাবও না।
আমার মনে হচ্ছে কারও কারও ভাষা অতি কুরুচিপূর্ণ হলেও সব মিলিয়ে এই কলরব থেকে নিশ্চিত ভাবে একটি সঙ্কেত উঠে আসছে। তা হলো বিশেষ বিশেষ পেশার মানুষের কাছ থেকে সমাজের বিশেষ কিছু সঙ্গত প্রত্যাশা থাকে। যেমন সাংবাদিক, কবি, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র ইত্যাদি। সেই প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হতে দেখলে মানুষ প্রথমে প্যাঁক দেবে, তারপর গাল, অবশেষে হাতের কাছে পেলে ঢিল ছুড়ে মারবে। কেন না দিশা দেখানোর দায়িত্ব যাঁদের, যাঁদের উচিত নিজেরা দৃষ্টান্ত হয়ে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা, তাঁরাই যদি দলে দলে দলদাস হয়ে যান বা ক্ষমতার পোষ্য, তাহলে বিপথগামিতার মূল্য তাঁকে চোকাতেই হবে। তখন ধরে নিতে হবে গাছের খেলে তলারটা কুড়োনো যাবে না।
জয়ের কবিতার বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন দিয়ে অর্কদেবের কথা শুনছিলাম। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত যুবা, সুন্দর কথা বলেন। কথায় কথায় তিনি সলঝনেৎসিনের প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, সাধারণ মানুষের উচিত মিথ্যা থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা আর কবি-লেখকদের কাজ হলো ক্রমাগত মিথ্যাকে প্রতিহত করে চলা। এমন উদ্ধৃতি আমি এখনই বিশটা দিতে পারি, মূল প্রশ্নটা হলো সলঝনেৎসিনের পথে চলছেটা কে? বাংলা বাজারে এমন একজনকেও দেখাতে পারবেন কেউ?
চ্যারিটি শুড বিগিন অ্যাট হোম। তাই নিজের পেশার কথা দিয়েই শুরু করছি। অনেকবার বলেছি, লিখেছি, আবার বলছি, বাংলা-সহ গোটা ভারতবর্ষেই সৎ, নির্ভীক সাংবাদিকতা আজ ভেন্টিলেটরে চলে গিয়েছে। ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিয়েছেন ব্রেইন-ডেথ, এখন কেবল চিতায় ওঠার অপেক্ষা। সত্যিকার সাংবাদিকতা বলতে অনেকে অনেক রকম বোঝে। যেমন বিনোদ দুয়া মনে করতেন সরকারের বিরোধিতা করাই সাংবাদিকের কাজ। গৌরকিশোর ঘোষ সাংবাদিকতাকে রাজপথে নামিয়ে আনার পক্ষপাতী ছিলেন, সমাজে কোনও রকম অনিষ্ট দেখলেই তিনি সেখানে সশরীরে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আমরা সাংবাদিকতা বলতে বুঝেছি কিঞ্চিৎ অন্য কথা। সাংবাদিকের আনুগত্য হবে একমাত্র সত্যের প্রতি, আর কোনও কিছুর প্রতি নয়। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি সমাজের মঙ্গল হয় ভালো, না হলেও আমার কিছু করার নেই। আমার পেশায় আমার নায়ক হলেন হ্যারিসন সলসবেরি যিনি ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিনিধি হয়ে ভিয়েতনামে গিয়ে পেন্টাগনের মিথ্যা সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পাঠানো রিপোর্টগুলি পড়েই মার্কিনরা প্রথম জানতে পারেন, জনসন প্রশাসন এতদিন কেবল তাঁদের ঢপের পর ঢপ দিয়ে গিয়েছে, যুদ্ধে আমেরিকা জিতছে না, বরং নির্মম পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সলসবেরি দেশদ্রোহিতা করেছেন এই অভিযোগে পুলিৎজার কমিটি তাঁকে পুরস্কার দিতে অস্বীকার করলেও মার্কিন জনতার আদালতে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক। সাংবাদিকতায় এমন চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব ভারতে কখনও আসেনি। তবু যেটুকু পারি না কেন আমি এই পথেই হাঁটতে চেয়েছি। সাংবাদিকতার প্রাণভোমরা হল তার বিশ্বাসযোগ্যতা। সেটা উবে গেলে হাতে পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আমাদের হালও হয়েছে তাই।
একই কথা প্রযোজ্য বাংলার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতাদের ক্ষেত্রেও। সৃষ্টিশীলতার জগতে অনেকেই বামফ্রন্ট আমলেও তাদের অনুগত ছিলেন। তাঁদের একটা সুবিধে ছিল, মোসাহেবিকে তাঁরা আদর্শের মোড়কে মুড়িয়ে রাখতে পারতেন। সত্যের খাতিরে এ কথাও স্বীকার করা প্রয়োজন আনুগত্য আর আখের গোছানো বাম-জমানায় সমার্থক ছিল না। জমানা বদলের পরে ছবিটা আশ্চর্য রকম বদলে গিয়েছে। এখন ভোট এলে গোটা টালিগঞ্জ পাড়াটাই যুযুধান রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে, মায়ের চরণে অথবা বাবার চরণে সেবা লাগানোর জন্য পড়ে যায় রেশন দোকানের লাইন। মাল দাও টিকিট দাও। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দিনগুলি থেকে যে মুখগুলোকে নেত্রীর পাশে দেখা গিয়েছিল, কয়েক জন বাদে তাঁরা অনেকেই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে ডুডু আর তামাক দুটোই খাচ্ছেন। সে সময় যাঁরা নেত্রীর বাপ-বাপান্ত করেছিলেন তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ হয় চেয়ারের জল মুছে নতুবা জয়ধ্বনি দিয়ে দুধের পাত্রটি নিজেদের আয়ত্ত করে ফেলেছেন। এই গলিত শবের নাম উইঙ্কল টুইঙ্কল, প্রাণ-কল্লোলে নবযুগ আসা যেন অলীক স্বপ্ন।
অতএব আমার মনে হলো আমার ফেসবুক পেজ ও প্রোফাইল ব্যবহার করে লোকে জয়ের ওপর টিপ প্র্যাকটিস করবে, এটা হতে পারে না। জয়ও মহারানির সেবায়েত, তবু তাঁর সেবার মধ্যে আদিম উদ্দামতা নেই, দৃশ্যত কোনও আতিশয্যও নেই। ফলে সব বেটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে আমি ধরতে পারি কিন্তু লিঞ্চ মবের হাতে তাকে তুলে দিতে পারি না। হাজার হোক জয় গোস্বামী আমার দীর্ঘকালের বন্ধু ও সহকর্মী, তার কবিতার আমিও একজন অযোগ্য কিন্তু ভক্ত পাঠক। জয় যা বাঁ হাত দিয়ে পারে আমি তো তা সারা জীবন চেষ্টা করেও পারব না। মানে একটা কবিতা লিখতে।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

