- August 13th, 2022
ভূতের বেগার খাটা
নীলার্ণব চক্রবর্তী
১.
পুরীর সাগরতীরে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে, ছাতার নীচে বসে আছি। সামনে সমুদ্র ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙছে। পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। একটু বিরক্ত হলাম, ফোনটা বার করে দেখলাম, একটা ছোট্ট মেসেজ— আসছি। একটু অপেক্ষা করুন। নম্বরটা অচেনা। অবাক হলাম। কে আসবে এখানে আমার জন্য? পুরীতে আমি একা এসেছি। জীবনে কখনও একটু একাকিত্বের প্রয়োজন হয় বলে। নিজের সঙ্গে থাকলে, ভিতরে লেখা তৈরি হয়। কিন্তু কে আসবে? কার জন্য অপেক্ষা করতে হবে? আপেক্ষা তো করতেই হবে যখন আসবে বলেছে। কেউ যখন আসতে চাইছে তাকে বাধা দেওয়া তো আমার কর্ম নয়। এই সব ভাবতে ভাবতে এক ঠোঙা বাদাম কিনলাম। তখন দুপুর আড়াইটে বেজেছে। রাতে পড়াশুনো করেছি, অল্প লিখেছি, ঘুম হয়নি, তাই তন্দ্রা-মতো।
ঘুমিয়ে পড়লেন? একটা ডাকে চটকা ভাঙল। তাকিয়ে দেখি একজন বেঁটে মতো মানুষ। মধ্যবয়সী। পরনে ফুলপ্যান্ট আর টি-শার্ট। আমার দিকে তাকিয়ে হাঁ-করে। আমি উঠে দাঁড়ালাম— আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!
চেনার কথাও নয়...
আপনি আমায় মেসেজ করেছিলেন? নম্বর পেলেন কী করে?
এখনকার দিনে কারও নম্বর পাওয়াটা কোনও ব্যাপার হল! তা, একা একা পুরী বেড়াতে চলে এসেছেন দেখছি?  
হ্যাঁ, এসেছি। একা আসার মধ্যেে তো কোনও অন্যায় নেই!
না অন্যায় থাকবে কেন, অন্যায় থাকবে কেন?
কিন্তু...আপনি...
এ বার দেখলাম লোকটার মুখে একটা রহস্যজনক হাসির ঝিলিক। আমি কিছুই ঠিক বুঝতে পারছি না। লোকটা কে, কোনও দিনই তো একে দেখিনি। কড়া গলায় বললাম, আপনি মেসেজ করেছিলেন কেন, সেটা তো বুঝতে পারছি না...
লোকটার কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। তার ভিতরে হাত ভরে দিয়ে একটা কাগজ বার করে আনল। তারপর সেটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি হাতে নিয়ে দেখলাম,  তার উপর বড় বড় করে লেখা— সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
২.
বেঁটে মতো লোকটার পরিচয় জানতে পারছি না। জিজ্ঞেস করলেই বলছে পরে বলবে। আমাকে সে নিয়ে যাচ্ছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আমি একটা বড় লেখা লিখব বলে তোড়জোড় করছি। সুভাষ ও সুভাষ বিষয়ে বইপত্র নিয়ে এসেছি ভ্রমণে। ফলে লোকটার ডাকে আমি সাড়া দিয়েছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য এখন কারও হওয়ার কথা নয়, আমিই সেই বিরল ব্যক্তি হতে চলেছি। হাঁটছি সমুদ্র সৈকত ধরে। লোকটা দু-এক পা আগে হাঁটছে। কথাও বলছে। সব কথা আমি বুঝতে পারছি না। প্রসঙ্গ থেকে চলে যাচ্ছে প্রসঙ্গান্তরে।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর বালির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই দেখুন লেবুতলা লেন। কলকাতার লেবুতলা লেন চেনেন তো।...
আমি হতবাক হলাম। সমুদ্রের তীরে লেবুতলা লেন? চোখ ভালো করে কচলে নিয়ে দেখলাম, চোখের সামনে বালি নেই, পুরোদস্তুর কলকাতার রাস্তা, লেবুতলা... তবে এখনকার নয়, সাদাকালো, সেই অতীতের... কানে আসছে তখন ভিস্তিওয়ালাদের হাঁকডাক। কয়েক জন ভিস্তিওলাকে দেখাও গেল রাস্তার কলে ভিড় করে আছে। দেখা গেল, দোহারা চেহারার এক জনের কোলে একটি শিশু। বয়স আন্দাজ চার। লোকটা বলল, ওই শিশুটিকে চেনেন? আমি যন্ত্রচালিতের মতো ঘাড় নেড়ে বললাম— না। আমার দিকে তাকিয়ে এক অলৌকিক হাসি দিয়ে লোকটা বলল, ও-ই হল সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বাংলার ডাকসাইটে কবির শৈশব দেখুন...। আর যার কোলে রয়েছে,  ও হল ওদের বাড়ির ওড়িয়া পাচক। নাম মোহন। খুব পান খায়। স্পষ্ট দেখলাম, মোহনের মুখ পানে ভর্তি। কোলে শিশু সুভাষকে নিয়ে কী যেন গুনগুন করে গাইছে। হঠাৎ মোহনের মাথাটা ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে সুভাষ বলল, দাও, ও মোহনদাদা, পান দাও...। মোহন আহ্লাদে সুভাষের গালে গাল ঘষে দিল। তারপর নিজের মুখ থেকে পানের অংশ বার করে সুভাষের হাঁয়ের ভিতর দিয়ে দিল। সুভাষের গালে একটা চুমুও খেল শব্দ করে। পান-ছাপ গালে লেগে গেল।
আমি ওই দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম গোটা দৃশ্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। লেবুতলা হয়ে উঠছে সাগরবেলা। আবার সমুদ্রের গর্জন কানে এসে ঝাঁপ কাটল। বেঁটে মতো লোকটা বলল, কী দেখছেন, চলুন যেতে হবে আমাদের আরও কিছুটা। হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে ওই দৃশ্যটা ঘুরছে। লোকটা কী যেন অনর্গল বলে যাচ্ছিল, সেই দিকে কান দিচ্ছিলাম না। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল, ওই যে ওই দেখুন...।
দেখলাম, বিচের সামনে অংশটা ফের কলকাতার রাস্তা হয়ে গেছে। তবে আগের মতো নিরুপদ্রব নয়, এবার শোনা যাচ্ছিল বন্দে মাতরম ধ্বনি। পুলিশের বুটের শব্দ ভেসে এল, একদল পুলিশও মার্চ করে চলে গেল। ধক করে নাকে এসে লাগল বারুদের গন্ধ। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছেলে, 'বন্দে মাতরম পুলিশের মাথা গরম', বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে উধাও। বোঝা যাচ্ছে, এ সেই আইন অমান্যের কলকাতা। বেঁটে মতো লোকটা বলল, ওই দেখুন সুভাষ। দেখলাম, শার্প চেহারার একটা ছেলে, বয়স আন্দাজ দশ কি এগারো। সঙ্গে যাচ্ছে মধ্যবয়সী একজন। বেঁটে মতো লোকটা আমায় বলল, সঙ্গের লোকটা হচ্ছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের বাড়িঅলা রামদুলালবাবুর দাদা, নাম জানি না। রামদুলাল জেলে, তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে এরা। দেখুন না কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কী এক্সপিরিয়েন্স হয়! দেখলাম, দু'জন রাস্তায় খানিক হেঁটে, ট্রামে উঠল। তারপর ট্রাম চলতে চলতে চলতে জেলের সঙ্গে দেখা করল, মানে জেলে পৌঁছল— আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, প্রকাণ্ড একটা সিং-দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমান যমদূত সেপাইকে যেন কী একটা দিলেন ওই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। কোনও লিফাফা মনে হয়। সেপাই সেটা উল্টে পাল্টে দেখে ভিতরে নিয়ে গেল, মিনিট দুয়েক পর বেরিয়ে এসে সুভাষদের কী যেন বলল, জেলখানার মধ্যে ঢুকে পড়ল দু'জন। জেলখানার ভিতরে একদল বন্দি বন্দেমাতরম স্লোগান দিচ্ছেন তখন। গোটা চত্বরে তার কম্পন উঠেছে। একজন সেপাই ওই দু'জনকে নিয়ে যাচ্ছিল রাস্তা দেখিয়ে, একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ-হাতের শেষ-ঘরে দেখা গেল বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেঝেতে শতরঞ্চি পাতা। ‘ঘর ভর্তি লোক। ঘরে একটি মাত্র টেবিল ও চেয়ার। চেয়ারের উপর যিনি বসে আসেন, তাঁকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কাগজের ছবিতে হুবহু এই মুখ দেখেছি— সুভাষচন্দ্র বসু না? কয়েদ-গাড়ি থেকে একটা করে দল নামছে আর তিনি ছুটে বাইরে যাচ্ছেন। তাদের জড়িয়ে ধরে বলছেন, তোমরা এসেছ?’
৩.
ডিসেম্বর মাসের শেষ। কিন্তু দুপুরের রোদে গা গরমে চিড়বিড় করছে। বেঁটে লোকটাকে বললাম, এবার একটু বসতে হবে, ক্লান্ত লাগছে। উনি ঘাড় এলিয়ে সম্মতি দিলেন। বালির উপর, আমার পাশেই গা-ঘেঁষে বসলেন। আমরা দু'জনে সমুদ্রের দিকে তাকালাম, দেখলাম দিকচক্রবালে নৌকারা হারিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে আমার একটু অন্য জাতীয় অনুভূতি হয়। আসলে নৌকাগুলি পৃথিবী থেকে রসাতলে পড়ে যাচ্ছে, তার আওয়াজ শুনতে পাই। ভয় লাগে আমার... পীড়া দেয়।
ঠিক করে বলুন তো কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
- বলেছি তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
- কেন?
- উনি আপনাকে ডেকেছেন, তাই!
- সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমায় ডেকেছেন, মানে, সে কী করে সম্ভব...
- অনেক সময় অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়! মনে আছে তো, ‘আমি তবু পদাতিক; হাতে বাজছে রণবাদ্য দ্রিমিকি দ্রিমিকি—/ কাছে এসো রত্নাকর, দূর হটো বাল্মীকি।।’
- আমি রত্নাকর নাকি ?
- ঠিক বলতে পারব না, হয়তো...!
- ঠিক করে বলুন আমাকে হঠাৎ কেন?
- কী কারণে ডেকেছেন, সেটা জায়গামতো গেলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে তাই না।
- কিন্তু...
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম আকাশপাতাল। ছোটবেলায় যে ক'জন কবির নাম শুনেছিলাম, তার মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কি না মনে পড়ছে না। তবে একটু বড় হয়েই সুভাষের কবিতা পড়ে বিস্মিত হতবাক স্তম্ভিত নির্বাক হয়ে গিয়েছি।    
- বিস্মিত হতবাক স্তম্ভিত নির্বাক! ভালো ব্যাখ্যা দাদা?
- কিন্তু আমি তো... আমি তো মনে মনে বলেছি... আপনি...
- হ্যাঁ, মনের কথা জানতে পারি আমি, সাবধানে কথা বলবেন মনে মনে...
- কী বলছেন এ সব?
- হ্যাঁ, কমিউনিস্ট জমানায় আমার হাতেই ছিল ক্ষমতা, মনে মনেও বিদ্রোহ করা যেত না, এখন সেই জমানার পতনের পর...
- সবাই যা ইচ্ছে অন্তত মনে মনে বলতে পারছে তাই তো?
- হা হা হা হা... হা হা হা হা... যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ, সুভাষবাবুই বলেন...
- ওনার তো মোহভঙ্গ...
- বাজে কথা বলবেন না, কোনও মোহভঙ্গ নয়, মানুষের প্রতি কোনও দিনই ওনার মোহভঙ্গ হয়নি... আজও নয়... কিন্তু দল...
- হ্যাঁ ওর দল... মানত না... শুনুন, কোনও নীতি রূপায়ণের আগে আমাদের পার্টি সদস্যদের ও জনসাধারণকে তার ব্যাখ্যা করতে হবে। না হলে পার্টি সদস্য, জনসাধারণ নীতি থেকে পৃথক হয়ে যাবে। ভুল নীতি অন্ধের মতো অনুসরণ...  
- মাও বলছেন দাদা, মাও আওড়াচ্ছেন?
- হ্যাঁ, মাও...
- কিন্তু এ সব কিছুই হয় না পার্টিতে, মানে, পলিসি ঠিক হয়ে যায়, তা মানুষকে অন্ধের মতোই অনুসরণ করতে হয়। মাওয়ের দেশেই মাও এখন শুধু দেওয়ালে ঝুলছেন, তিনি ফরবিডন হয়ে গেছেন।... আর সুভাষবাবু?
- দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে বাঁধবে না কেউ?/ ফসলের ওই পাকা বুকে, আহা, বন্যার ঢেউ!/ দস্যুর স্রোত বাঁধবার আগে সংহতি চাই/ জাপ পুষ্পকে জ্বলে ক্যান্টন জ্বলে সাংহাই।... আ ওয়েল-ডিসিপ্লিন্ড পার্টি আর্মড উইথ দ্য থিওরি অফ মার্ক্সিজম-লেনিনিজম, ইউজিং দ্য মেথড অফ সেলফ ক্রিটিসিজম অ্যান্ড লিঙ্কড উইথ দ্য মাসেস অফ দ্য পিপল...
- সেলফ ক্রিটিসিজম, লিঙ্ক উইথ দ্য মাসেস... হা হা হা...
- হ্যাঁ সুভাষ মুখার্জি, একজন বিপ্লবী, এই জায়গাতেই চাপে পড়ে গেলেন...
- দল ক্ষমতায় না থাকলে এক রকম, কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে অন্য-- তাই না?... সেলফ ক্রিটিসিজম এবং রিভিশনিজমের মধ্যে ফারাকটা কি গুলিয়ে যাচ্ছিল অনেকের...? লিন পিয়াওয়ের একটা কথা মনে পড়ছে। ‘যখন মাও দে জংয়ের চিন্তা বিশালাকার আম জনতা আত্মস্থ করে ফেলবে, তখন তা অশেষ শক্তির জন্ম দেবে, আধ্যাত্মিক পারমাণবিক বোমা হিসাবে সীমাহীন ক্ষমতা উৎপন্ন করবে।’... আধ্যাত্মিক পারমাণবিক বোমা কেন? কী বুঝলেন, স্পিরিচুয়াল অ্যাটম বম্ব... তার মানেই একটা অন্ধত্ব, তাই না...?
- এখানেই বলছেন গণ্ডগোল...?
- ইয়েস, এখানেই, এখানেই আদর্শের মধ্যেই সঙ্কট, অবশ্য আমাদের বোঝার ভুল হওয়াটাও অসম্ভব নয়...
- কিন্তু অ্যাবোলিশন অফ অল রাইটস অফ ইনহ্যারিটেন্স কি সম্ভব নাকি?
- আসলে সব কিছু ছাপিয়ে ছুপিয়ে ওঠে কলহপ্রিয়তা, তত্ত্বটত্ত তখন গত্তে ঢুকে যায়। তাই দলের কাছে সত্যিই সত্যিই সুভাষ তখন— মুখ্যু।
- এত ভাগ হলে আর কী করে হবে, কিছুই হবে না, হয় না... কাশ্মীরের ছেলে জলিমোহন কল, সুভাষের বন্ধু, বলেছেন ডাঙ্গের সেই চিঠি নাকি জাল ছিল, সে সময় ডাঙ্গেও বলেছিলেন, বলেছিলেন অনেকেই, কিন্তু জ্যোতি বসুরা ডাঙ্গের হাতের লেখার সঙ্গে চিঠির লেখা পরীক্ষা করাতে চাননি। ব্রিটিশকে লেখা সেই চিঠির কথা বলছি... মনে আছে তো?
- তা আর থাকবে না দাদা, পার্টি ভাগের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল ওই চিঠিটা। বিপ্লবী পার্টি ফেটেফুটে গেল। সিপিএম... আহা...বিপ্লবের ঝাপসা ও ভ্যাবসা ছবি এখন... জ্যোতি গেল, বুদ্ধ এল, গেল... রেভোলিউশন ইজ নট আ ডিনার পার্টি, অর রাইটিং অ্যান এসে, অর পেইনটিং এ পিকচার, অর ডুইং এমব্রয়ডারি; ইট ক্যান্ট বি সো রিফাইনড, সো লেজারলি অ্যান্ড জেন্টল, সো টেমপারেট, কাইন্ড, কোর্টিয়াস,রেস্ট্রেইন্ড, ম্যাগনানিমাস। এ রেভোলিউশন ইজ অ্যান ইনসারেকশন, অ্যান অ্যাক্ট অফ ভায়োলেন্স বাই হুইচ ওয়ান ক্লাস ওভারথ্রোজ অ্যানাদার।
- মাওয়ের খুব ক্লিশে কথাগুলি শোনালেন।... তবে, সুভাষ চিরটা কাল অ্যান্টিএসটাবলিশমেন্টের দিকে। কেউ লঙ্কায় গেলে যে রাবণই হয়, সেটা ওর মর্মে গেঁথে ছিল। কমিউনিজম মানে শুধু বুর্জোয়াকে ছুড়ে ফেলা নয়, ক্ষমতা দখলও কিন্তু... চরিত্র বজায় রেখে সেই দখল-টা ঠিক হ্যান্ডেল করতে পারেনি কমিউনিস্টরা, তাই না?
- ওর ওই গোটা ব্যাপারটায় একটা দোটানা ছিল। দ্বিধা থরথর চূড়ে... না হলে কংগ্রেসের সভায় ওঁকে দেখা যেত না, তৃতণমূলে দিকে যেতেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপন করতেন না! তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বাস বলতে কী বোঝায়? আমরা মানুষের ভাল চেয়েছিলাম, এই বিশ্বাস কি ভেঙে গিয়েছে? মানুষের কতগুলো মূল্যবোধ থাকা উচিত, এই বিশ্বাস কি ভেঙে গিয়েছে?  আমি বলব না। কিন্তু আমরা যে কতগুলো জিনিস ধরে নিয়েছিলাম, সেই ধারণাগুলো এখন মনে হচ্ছে ভুল।’
ওই যে বললাম, অ্যান্টিএসটাবলিশমেন্ট... প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছিল নকশালরা, সুভাষ ওদের রক্তযুদ্ধের দিকে হারা ঝান্ডা তুললেন, তারপর মমতা বন্দ্যোকেও তো ওই বিরোধিতার কারণেই বন্দনা করলেন, এখন থাকলে আর করতেন না হয়তো, কারণ, এখন তো মমতাই ক্ষমতায়। যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ, কী বলেন ?... ‘ভোটের আগে কী যে সজ্জন/ ভোটের পরে কী যে গর্জন।’ প্রতিষ্ঠান সুভাষের গায়ে জ্বালা ধরিয়েছে। ‘বাবু হয়ে বসে গদিতে।/ ভুলে গেছে ভুঁয়ে পা দিতে।/ দেশের লোকের ছাড়ছে নাড়ি।/ বাড়ছে দলের গাড়িবাড়ি।/ মন্ত্রীমশায় করেন কি?/ পরের ধনে পোদ্দারি।’  
- সুভাষকে কি শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট ছিলেন?
- হানড্রেড পারসেন্ট। মার্ক্সবাদের সঙ্গে তাঁর নিজের টীকাও জুড়ে থাকত। এমনও বলা যায় সুভাষ প্রণীত মার্ক্সিজম, গোদা মার্ক্সিস্টদের ওটা পোষাবে না।... জানেন আশা করি, আম আদমিকে মার্ক্সিজম বোঝাতে চেয়েছেন, কার্ল মার্ক্সের ‘ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল’ বা ‘মজুরি ও পুঁজি’ বইটা জলবৎ করে লিখেছেন ‘ভূতের বেগার’... বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘আমাদের দেশে মার্ক্সবাদ-পড়া পণ্ডিতের অভাব নেই। দুঃখের বিষয়, তাঁরা বিদ্যের জাহাজ হয়ে বসে আছেন— কম লেখাপড়া-জানা মানুষের কাছে খানিকটা জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার চাড় তাদের দেখা যাচ্ছে না।’ এই বই বেরোয় ১৯৫৪ সালে। অনেক কথা শুনতে হয় সুভাষকে, সমালোচনায় জেরবার হতে হয়... পার্টির সঙ্গে তার দূরত্বও তৈরি হতে থাকে। তারপর... হ্যাঁ, ১৯৮৪ সাল, সিপিআইয়ের সদস্যপদ নবীকরণ করলেন না সুভাষ। ৪০ বছরের পার্টিজীবন শেষ হল... ‘আমার যে বন্ধুরা পৃথিবীকে বদলাবে বলেছিল/ তর সইতে না পেরে/ এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বদলে ফেলেছে।’... নাহ চলুন এবার ওঠা যাক। সুভাষদা অপেক্ষা করছেন।
৪.
সাগরতীরে বিকেল নেমেছে। তেমন ঠান্ডা নেই, হালকা একটা হাওয়ায় শুধু ঠান্ডা আবেশ। সাগর পেরিয়ে আসছে হাওয়াটা। আমরা হাঁটছি। বেঁটে মতো লোকটা গান গাইছে। আব দিন উও প্যায়ারা আয়া হ্যায়...
এক সময় আমিও রাজনীতি করতাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। তবে কী করতাম একটা সময় পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। দাদাদের নির্দেশ তামিল করে গিয়েছি, পার্টিক্লাসে খাতার পর খাতা টুকে নিয়ে তারপর মুখস্ত করেছি। সেই সব খাতা এখনও রয়েছে ট্রাঙ্কে, কিছু উঁইয়ে খেয়ে নিয়েছে, বিপ্লব একটা পোকা, হয়তো সেই পোকাটার নাম উঁই, বা তার চেয়েও মারাত্মক পোকা কোনও— মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তোলায় পোকাটা, সূর্যের দিকে নিয়ে যেতে চায়, ক্রমশ মাটি আলগা হয়ে যায় পায়ের।  
‘তুমিই আমার মিছিলের সেই মুখ—/ এ প্রান্ত থেকে ও প্রাপ্ত যাকে খুঁজে/ বেলা গেল।/ ফিরে দেখি সে আগন্তুক/ ঘর আলো করে বসে আসে পিলসুজে।// দিনে দূরে ঠেলে দিনান্তে নিলে কাছে/ ঠা-ঠা রোদ্দুরে পাইনি কোথাও ছায়া,/ নীল সমুদ্র পুড়ে গেছে সেই আঁচে/চোখ মুছি—/ তুমি স্বপ্ন!/ না, তুমি মায়া’...
বিপ্লব বড় মায়াবি। এ বাংলার ছেলেদের লাল টুকটুকে দিনের দিকে ডাকে সে। বজ্র আকাশকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়। কিন্তু আলো আর আমি আঁধারের আল বাইতে বাইতে আর বাইতে... লাল টুকটুকে দিন দূরে চলে যেতে থাকে, ধাওয়া করেও ধরা যায় না আর।
বেঁটে লোকটা বলল, ওই দেখুন দাদা, ওই যে আবার। দেখলাম আরও একবার সেই খেলাটা শুরু হয়েছে, আবার বিভ্রম— সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই বিশ্বস্ত কমরেড কি কোনও জাদুকর, বিদেশে বিচে বিভ্রমে কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে?
দেখলাম, সাগরতট এবার একটা গ্রাম, এক কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে। পিছনে পাশে গাছপালা। দাওয়ায় রান্না চাপিয়েছেন এক মহিলা। বেঁটে লোকটা বলল, ইনি হলেন গীতা মুখোপাধ্যায়। সুভাষবাবুর স্ত্রী। এরপর, ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম, ভিতরে একটি খাটে বসে সুভাষ। কী যেন লিখছেন।
বেঁটে মতো লোকটা বলল, এটা বজবজের ব্রাহ্মণহেড়িয়া গ্রাম। এই কুঁড়ে-বাড়ি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভাড়ায় নিয়েছেন। চটকলে এখান থেকে গিয়ে আন্দোলন করেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে মানুষ বুঝতে চান সুভাষ-গীতারা। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও যান, পড়াশুনো করেন ইতিহাস নিয়ে। ছোটদের জন্য বাঙালির ইতিহাস লিখবেন বলে।
এই সময় দেখা গেল, একজন এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এসে দাঁড়াল দাওয়ার সামনে, পিছনে এক কিশোরী। গীতা তাদের দেখে বললেন, আরে বাবর আলি... বসো, বসো... সালেমন বসো...।
দেখা যায়, বাবর আলির চোখ দুটো যেন আকাশের মতো, সেখানে হালকা হালকা মেঘ... এক সময় এই চোখের বদল হয়েছিল, বদলে যাওয়া সেই চোখেই মেয়ে সালেমনের দিকে চেয়েছিল বাবর, স্ত্রী গোলসানকে খুঁজে ফিরত সালেমনের ভিতর, গোলসান এক রেস্তঅলা আধবুড়োর গলায় ঝুলেছে। তখন অবশ্য বাবর আলি পাগল ছিল, তারপর পাগলামি কোথায় গায়েব হয়ে গেল কে জানে, স্ত্রীকে খুঁজে ফিরতে শুরু করল কন্যায়, এও এক ধরনের পাগলামিই বটে। নাহ, বাবরের সে পাগলামি বেশি দিন চলেনি। তুরতুরে মেয়েটাকে বাবর বুকে জড়িয়ে ধরে একদিন বলেছিল, আমার জিওনকাটি... সালেমনের মা-কে নিয়ে সুভাষ কবিতা লিখেছিলেন, সেটাই একদিন বাবরকে শোনাবেন বলেছিলেন, আজ সেই কবিতাটা শুনতেই এসেছে বাপ-বেটি। গীতাও জানতেন সে কথা, তাই ‘ওগো শুনছ বাবর আলি এসেছে কবিতা শুনতে—’ দেখা গেল, মুখভর্তি হাসি নিয়ে দাওয়ায় বেরিয়ে এলেন সুভাষ। হাতে একটা বই। দূর থেকেই নাম বোঝা যায়, ফুল ফুটুক। সুভাষ দাওয়ায় বসেন, বেশ একটু আয়েস করেই, তারপর শুরু করলেন, ‘পাগল বাবরালির চোখের মতো আকাশ।/ তার নীচে পাঁচ ইস্টিশন পেরনো মিছিলে/ বার বার পিছিয়ে পড়ে বাবরালির মেয়ে সালেমন/ খুঁজছে তার মাকে।... দেখা যায় পিতা ও কন্যার দুজনের চোখেই তখন জলের প্রলেপ, সুভাষ একটু থেমে ফের পড়ে যেতে থাকেন, ‘এ কলকাতা শহরে/ অলিগলির গোলকধাঁধায়/ কোথায়, লুকিয়ে তুমি,/ সালেমনের মা?/ বাবরালির চোখের মতো এলোমেলো/ এ আকাশের নীচে কোথায়/ বেঁধেছ ঘর তুমি, কোথায়/ সালেমনের মা?/ মিছিলের গলায় গলা মিলিয়ে/ পিচুটি-পড়া চোখের দু'কোণ জলে ভিজিয়ে/ তোমাকে ডাকছে শোনো,/ সালেমনের মা—/ এক আকালের মেয়ে তোমার/ আরেক আকালের মুখে দাঁড়িয়ে/ তোমাকেই সে খুঁজছে।।... শেষ শব্দগুলো আবছা হয়ে যায়, সমুদ্রের আওয়াজে চলে যায়, দৃশ্যটাকে সঙ্গে করে নিয়ে।
৫.
আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে। সাড়ে চারটে কিন্তু বেজে গেল।
না আর বেশিক্ষণ নয়।
বেঁটে মতো লোকটা একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দিয়েছি, অনেক দিন বাদে একটা ধরালাম, কিছু মনে করবেন না আশা করি...
দু'জনেই হাঁটার গতি একটু বাড়য়ে দিয়েছি। ভিতরে কে যেন বলছিল, একটু পা চালিয়ে, ভাই। বালির উপর বেশি জোরে হাঁটা যায় না। গতি যেন বালি শুষে নেয়।...
আকাশে সূর্যটা এ বার লাল হয়ে গেছে পুরো। এখুনি আত্মহত্যা করবে জলে। এই সময় এই পা দশেক দূরে দেখা গেল, একটা ইজিচেয়ার। সৌরবর্ণ সমুদ্রের ঢেউগুলি ইজিচেয়ারে পায়ের কাছে এসে ভাঙছে। চেয়ারে কেউ বসে নেই।
বেঁটে মতো লোকটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই তো...
আমি বললাম, ওই তো কী?
- যিনি আপনাকে ডেকেছেন, তিনি।
- ওটা তো ফাঁকা ইজিচেয়ার, সুভাষবাবু কোথায়?
- ওখানেই তো বসে আছেন।
- কী উল্টোপাল্টা বলছেন দাদা... কোথায়... কাউকে তো দেখতেই পাচ্ছি না...
- ভাল করে দেখুন...
- হ্যাঁ, ভালো করেই দেখছি, কেউ বসে নেই...
- সূর্যটা তখন আর আকাশে নেই। আকাশটা পুরো লাল হয়ে গেছে।
- দেখতে পাচ্ছেন না?
- না, পাচ্ছি না—
- আরও ভালো করে দেখুন...
- কত ভালো করে দেখব বলুন তো, ওই তো একটা ইজিচেয়ার, কিন্তু ওটা খালি... চলুন তা হলে কাছে যাই...
- না কাছে যাওয়া যাবে না, আপনি যখন কাউকে দেখতেই পাচ্ছেন না... তা হলে...
- তা হলে কী...
- তা হলে আর কী... আপনাকে এখানে এনে আমি ভূতের বেগার খাটলাম... ভূতের বেগার... বুঝলেন তো?
(আজ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিবস)

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

