- August 13th, 2022
স্বজন পাড়ার পড়শিরা
নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত একটি মুসাবিদা
রাহুল পুরকায়স্থ
চাঁদের আলো, তেরছা, কার্নিশে গোত্তা মেরে আমার ব্যালকনির দক্ষিণ কোণে যখন এসে পড়ে, মনে হয় তারা আছেন। নানা ভাবের, নানা রঙের, নানা রসের, নানা কিসিমের আমার আত্মীয় স্বজন।
পার্কস্ট্রিটের অলিপাব আর গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউর ব্রডওয়ে, গ্রীষ্মদুপুরের এই দু’টি পানশালা ছিল আমার 'নির্জন দুপুর'। অলিপাবের দোতলায় উঠে ডানহাতের কোনার টেবিল, মাথার পিছনে আয়না, ছিল আমার পছন্দের জায়গা। আর ভেজা খসখসের ব্রডওয়ে, আহা! মনে হত যেন দগ্ধ কলকাতার একফালি ছায়া সুনিবিড় ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্রডওয়েতে মদের সঙ্গে ফ্রি শশা ও আদার কুচি।
সে দিন ছিল যে মাসের দু’তারিখ, দু’হাজার দুই কী তিন। দুপুরে উৎপলদার সঙ্গে একটু কথাবার্তা ছিল। উৎপলদা, উৎপল কুমার বসু। 'পেরেক ও সুতোয় বাঁধা এই চার দেয়ালের ঘর/.... আমাদের অস্ত্রের দোকান।' কথাবার্তা ছিল ওই অলিপাবেই। ওই টেবিলেই। বেলা ৩টে নাগাদ উৎপলদা উঠে গেলেন। ফাদারের সঙ্গে দেখা করতে। চিত্রবাণী। উৎপলদা উঠে যাবার মিনিট ২০ পরে তিনি এলেন। এদিক সেদিক দেখলেন, তারপর এগিয়ে এলেন আমার টেবিলের দিকে।
_ ভাই! আপনি একা? বসতে পারি এখানে? 
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উল্টোদিকে বসে পড়লেন। পরনে ধুতি ও বাংলা শার্ট। হাতা গোটানো। হাতে ঘিয়ে রঙের থলি। সামান্য হাসলেন। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকলেন 
_ তা ভাইয়ের কী করা হয়?
_ তেমন কিছু না।
_ সে কী! তেমন কিছু তো করতে হবে। করতে হবে মানে হয়ে যাবে। তা ভাই আমি হলাম গিয়ে শশধর রাহা। রাহা, লাহা নয়। লাহা হলে নির্ঘাত ভাবতেন রঙের কারবারি। তা আমারও অবশ্য ছোটখাটো দু-একটি কারবার আছে। তেলের। কেরোসিন ও নারকেল দুই-ই।
ওয়েটার ডাকলেন। 
_ ভাই আমাকে ওল্ডমঙ্ক দিন। আপাতত দুটো। আর এই ভাই কী নিচ্ছেন? 
আমি কিছু বলার আগেই ওয়েটার লালুদা বললেন, দাদা রয়্যাল স্ট্যাগ নেয়। 
_ তা ভাইকেও আর দুটো। আর হ্যাঁ, সঙ্গে মুরগি ভাজা। দু প্লেট। 
আমি ওপর ওপর একটু আপত্তি জানালাম। উনি ধর্তব্যে নিলেন না। 
এ বার ভালো করে লক্ষ্য করলাম রাহা মশাইকে। বয়স ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। মধ্যসিঁথি, গন্ধ তেল, চারমিনার, জর্দাপান, বড় বড় চোখ, চোখের পাতা চশমার কাচ ছুঁয়েছে।
_ তা ভাই, বলছিলাম কী, আজ এই টেবিল আমার। আজ আমার জীবনের একটি স্পেশ্যাল ডে। 
বলতে বলতে শার্টের পকেট থেকে বের করলেন একটি নোটবুক, নোটবুক থেকে একটি ছবি, পাসপোর্ট, সাদাকালো একটি মেয়ে, মেরেকেটে ষোলো কী সতেরো। 'ছবি যখন তুলছিল চোখ দেখে মনে হয় মেঘ ভাবছিল।' এক পশলা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেন উঁকি দিয়ে গেলেন।
_ কন্যা?
হো হো করে হেসে উঠলেন। 
_ কন্যা তো বটেই ভাই। তবে আমার নয়। কুমিল্লার কৃষ্ণধন সাহার। প্রথমা কন্যা। আমার অর্ধাঙ্গিনী, মীরা। আজ ওনার জন্মদিন। ওনার জন্মদিনেই বছরে একবার এখানে আসি। একটু এনজয় আর কী! 
_ নেন, চিয়ার্স!
_ চিয়ার্স! 
মুরগি ভাজা এলো। চিবোতে চিবোতে বললেন, এগুলো ব্রয়লারের, দেশি ছাড়া মেজাজ নাই।
_ স্ত্রীর জন্মদিন? একা এলেন যে! স্ত্রীকেও তো আনতে পারতেন? 
__ দূর! থাকলে তো আনবো! 
__ সে কী! নেই? 
__ আছে ভাই আছে। দেশান্তরে। নারায়ণগঞ্জের নাম শুনেছেন? ওইখানে। বিয়ের এক বছরের মাথায় যুদ্ধ, কোনোমতে আগরতলায় এলাম। যুদ্ধের পর মীরাকে নিয়ে মা-বাবা আবার ওই বাংলায়। আমি ভুজুংভাজুং দিয়ে থেকে গেলাম ইন্ডিয়ায়। বছরে দু-তিনবার যাই, সংসারধর্ম করি। তারপর আবার পলাতক। বাই-দা-বাই, পলাতক দেখেছেন ভাই? 
_ হ্যাঁ।
_ তাইলে তো জানেনই, আমি অনেকটা অনুপকুমার প্যাটার্ন।
প্রথম দিনের আলাপেই নিজেকে অনেকটাই খুলে দিতে চাইলেন শশধরবাবু। আমরা কয়েক জন তখন বিলের পিছনে সই করে বাকিখাতা চালু করেছিলাম অলিপাবে। ম্যানেজার হক সাহেবের দৌলতে। সেদিন শশধরবাবু আমাকে সই করতে তো দিলেনই না, উপরন্তু চার পাত্রের শেষে এক আশ্চর্য প্রস্তাব পারলেন।
_ বুঝলেন ভাই, আপনাকে এক ইচ্ছার কথা বলি। পরিচয় যখন হলই এ বার থেকে প্রতি বছর এই দিনে আমাদের দেখা হবেই। মনে রাখবেন, দোসরা মে, প্রতি বছর, বেলা চারটে, অলিপাবে। 
আমরা অবশ্য কেউই মনে রাখিনি। কেন না, পরপর আট বছর ওইদিন, ওই সময় আমাদের দেখা হয়েছিল ঠিকই, তবে এই আট বছরে, যতদূর মনে পড়ে, অতিরিক্ত বার তিনেক আমাদের দেখা হয়েছিল। একবার রেসের মাঠে। একবার ওনার কিছু টাকার দরকার পড়ায় তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার পরিচিত এক কাবুলিওয়ালার কাছে, গাঁজা পার্কের পিছনে। আরএকবার শশধরবাবুর নিমন্ত্রণে ওনাদের বাৎসরিক মাছ ধরার প্রোজেক্টে। 
কথামতো সকাল সকাল দাঁড়িয়ে ছিলাম ডানলপে। শশধরবাবু আমাকে ওনার আ্যম্বাস্যাডরে তুলে নিলেন। হাওড়ার দিকে। সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল। গিয়ে দেখি মস্ত এক জলাশয়। জলাশয়ের চারপাশে বিভিন্ন রঙের ছাতা। এক একটি ছাতার নীচে এক একজন সপার্ষদ মৎস্য শিকারি। গলায় কিছুটা রহস্য মাখিয়ে আমার মনের বিস্ময়সূচক চিহ্নটিকে পেন্ডুলামের মতো দুলিয়ে দিলেন শশধরবাবু।
_ বুঝলেন ভাই, এটা আমার একটা বাৎসরিক নেশা। ওই যে পশ্চিমে দু’নম্বর ছাতা, ওইটা আমাদের। আমাদের মানে আমার আর আমার এক ফ্রেন্ডের। ফ্রেন্ড এলো বলে। সেজেগুজে আসছে তো, তাই একটু সময় লাগছে।
একটু পরেই ফ্রেন্ড এলেন। সেজেগুজে। সঙ্গে আরও তিন সহচর। দু’জনের হাতে মাছ ধরার সরঞ্জাম আর একজনের পিঠে ব্যাগ আর দু’হাতে দুটো বড় জ্যারিকেন। বেশ ভারী। বইতে খানিক বেগ পেতে হচ্ছে। আর যার জন্য শশধরবাবুর অপেক্ষা, সেই বন্ধু অতীব রঙিন। মিশকালো গায়ের রং। হলদে ছাপা টি-শার্ট, সাদা বারমুডা, খালি পা, আর সেই মেঘলা সকালেও চোখে জব্বর এক সানগ্লাস। লম্বায় ছ’ফুট ছাড়ানো। হাঁটার ছন্দে একটু দোলাচল।
শশধরবাবু আমার কানের কাছে মাথা নামিয়ে যেন নিজের মনে মনে বলে উঠলেন, 'খেয়েছে! আজ সকাল থেকেই চড়িয়েছে! বুঝলেন ভায়া আমার এই বন্ধুটি দিলদরিয়া, নাম কানাই। আমি ডাকি ডাকনামে, পচা।' 
শশধর বাবু একটু এগিয়ে গেলেন, 
_আরে পচা, সকাল থেকেই মনে রং! দেইখাই বুঝছি। আসো, আসো। এই ভাইটি হইল গিয়া রাহুল, ওর কথাই কইসিলাম। আমাগো থিকা অনেকখানি জুনিয়র, আর্ট লাইনের লোক। তবে কেন জানি না, ও আমারে খুব টানে। আর রাহুল ভাই, এ হলো কানাই, কানাই দাস। আমার যৌবনের দোস্ত। একসঙ্গে কত কিছুই করছি। এই যে আমি এখন দু’পায়ে দাঁড়াইয়া, এই পা দুখানি ওর দেওয়া। কী বুঝলেন! সঙ্গ আপনার খারাপ লাগবো না। কাজেও লাগতে পারে।' 
কানাইবাবু আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। এ বার মাছ ধরার পালা। আমাদের জন্য তিনটি চেয়ার এলো, সঙ্গে ছোট একটি টেবিল। কানাইবাবুর সঙ্গী দু’জন ছিপ ফেললেন। আরেকজন ওই জ্যারিকেন থেকে আমাদের জন্য তিনটি মাটির খুড়িতে মদ ঢাললেন, সঙ্গে মৌরলা মাছ ভাজা। শশধরবাবু ও তাঁর বন্ধুটি লক্ষ্য করলাম, স্থল সাঁতারে বেশ পটু। ওদের মাছ ধরাটাও অন্যরকম। দুই সাকরেদ দু’টি ছিপ নিয়ে বসে, বঁড়শিতে মাছ লাগলেই শশধরবাবু ও কানাই বাবুর উদ্দ্যেশ্যে চাপা গলায়, 'স্যার লাগছে।' সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধু লাফ দিয়ে সেই ছিপের কাছে চলে যাচ্ছেন। মাছ উঠলে গদগদ। মাছ না উঠলেও গদগদ। নেশা জমজমাট!
_ বুঝলেন রাহুল, কানাইবাবু বলেন, বছরে এই একটা দিন ভদকায় থাকি। বাকি দিনগুলো বাংলায়। পুরানো অভ্যাস। ছাড়তে পারি নাই। বাংলার সমস্যা একটাই, খাইয়া কাউরে চুমু খাওন যায় না। কী কষ্ট। শশধরবাবু তার বন্ধু সম্পর্কে মাঝে মাঝে যে সামান্য ক’টি তথ্য দিলেন,
   ১) বন্ধুটি বড় কারবারি
   ২) মাঝেমাঝে শ্রীঘরে ঘুরতে যান
   ৩) বছর দুই আগে এক ডাকাতির কেসে ধরা পড়েন, ১৯ মাস জেল খেটে সবে বেরিয়েছেন।
   ৪) কখনও খুন করেননি
   ৫) দুই বিবাহ
নেশার বশে কানাইবাবু সেদিন দুপুরে তার বাড়িতে জোর করে নিয়ে গেলেন। শশধরবাবু অন্য কোথায় যেন কেটে পড়লেন।
কানাইবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, আহারের এলাহি ব্যবস্থা! মাছ, মাংস তো আছেই, সঙ্গে সাতরকমের শাক, সাতটি বাটিতে। কানাইবাবু খেতে খেতে বিভিন্ন শাকের গুণাগুণ বর্ণনা করছেন আর থেকে থেকেই বলে উঠছেন, 'রাহুল, খান... খান, শাক খান, যত শাক, তত বৃদ্ধি।' আহার সমাপ্তে বিশ্রাম। দোতলায় নিয়ে গেলেন। বিশাল একটি ঘর, এক ঘরে দু’টি পালঙ্ক। একটিকে তিনি নিজে বেছে নিলেন, অন্যটিতে আমাকে বিশ্রাম নিতে বললেন। 
দ্রব্যগুণে চোখ লেগে গিয়েছিল। যখন খুললো, সন্ধ্যা। পাশের পালঙ্কে কানাইবাবু আধাজাগ্রত। একজন সুবেশা বয়স্ক মহিলা তার পা টিপে দিচ্ছেন, আরেকজন যুবতীপ্রায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দু’জনের মুখশ্রীতে আশ্চর্য মিল। আমার ঘুম ভেঙেছে বুঝতে পেরে কানাইবাবুও সলজ্জ, উঠে বসলেন।
_ কী রাহুল ভাই, ঘুম কেমন হলো? ও, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি, ইনি আমার বড়টি আর ইনি ছোটটি। দুই বোন, এখন দুই সতীন, এই আর কী। তা চা না কফি না আরএকটু হবে? আমার ছেলেরা অবশ্য রেডি। মোটরসাইকেলে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। শশধর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে। আমি মোটরসাইকেলই বেছে নিলাম।
আট। পরপর আটবার দোসরা মে, বিকেল চারটে, অলিপাব হয়েছিল। এর মধ্যে একবার জায়গা না পাওয়ায় মন্টিকার্লো। আর দু’বার অলিপাবের একতলায়। বাকি পাঁচবার ওই আমার প্রিয় টেবিলখানিতেই। আর আটবছর পর? না, শশধরবাবু আর এলেন না। আটের পর নয় আর দশ, পরপর দু'বছর ওই একই দিনে, একই সময়ে আমি গিয়েছিলাম বটে, অপেক্ষাও করেছিলাম। কিন্তু শশধরবাবু, না। দশ বছরের ওই দিনে ওই সময়ে ওই টেবিলে গিয়ে দেখি বসে আছেন অমল ভট্টাচার্য। এক সময় কেনিয়া প্রবাসী, তখন কলকাতায়।
এ এক অন্য কাহিনি। অন্য কোনও দিন।

 
	 
							
 Arts and Literature
Arts and Literature Bioscope
Bioscope Columns
Columns Green Field
Green Field Health World
Health World Interviews
Interviews Investigation
Investigation Live Life King Size
Live Life King Size Man-Woman
Man-Woman Memoir
Memoir Mind Matters
Mind Matters News
News No Harm Knowing
No Harm Knowing Personal History
Personal History Real Simple
Real Simple Save to Live
Save to Live Suman Nama
Suman Nama Today in History
Today in History Translation
Translation Trivia
Trivia Who Why What How
Who Why What How

