- August 13th, 2022
গুমঘর গুলজার
সুমন চট্টোপাধ্যায়
খবরটা পেলাম আমার গিন্নির কাছ থেকে। বলল, নীলার্ণব নামের এক যুবা তাকে ফোন করেছিল, একটি বড় প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত, তোমার একটি বই প্রকাশ করতে চায়। মনে মনে ভাবলাম, আমার? কয়েদ ফেরত মাল আমি, সমাজ-সংসারে অস্পৃশ্য অথবা অপাংক্তেয়, আমার বই আবার কোন মূর্খ ছাপতে চাইবে? অচিরেই আবার বুঝতে পারলাম, পৃথিবীটা সত্যিই খুব ছোট, নীলার্ণব আমার অনেক দিনের পরিচিত, একদিনে একদা আমার সহকর্মী ছিল। তখন ওকে চিনতাম অর্ণব নামে, নীল আভাটি তৎসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরে, একেবারে আদালতে গিয়ে আইনি নিয়ম-কানুন মেনে।
বড় ভালো হত আমিও যদি অর্ণবকে টুকলি করে এই মওকায় নিজের নামটি বদলে ফেলতে পারতাম, এক্কেবারে নতুন পরিচয় নিয়ে হারিয়ে যেতে পারতাম জনতার ভিড়ে। আসলে আমাদের বামুনদের দ্বিজত্ব একটা মস্ত বড় ঢপবাজি। একই জন্মে পুনর্জন্ম যদি সত্যিই হওয়ার ছিল, তা হলে এটাই তো তার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। মরার পরে ফের জন্মানোর তো কোনও প্রশ্নই নেই, চালু জীবনে যদি একটা অণু-জীবন তৈরি করা যেত মন্দ হত না। যা কিছু প্রার্থিত আমার জীবনে তা আর পাওয়া হয়ে ওঠে না, ফলে প্রার্থনা করে সময় নষ্ট করাটাই বন্ধ করে দিয়েছি।
এর আগে আমি কখনও এমন একটি বই লিখিনি, লেখার কথা ভাবতেও পারিনি। কেন না কোনও রকম বেআইনি কাজ না করেও স্রেফ লেখালেখির জন্য আমাকে একদিন অকস্মাৎ গুমঘরে চালান করে দেওয়া হতে পারে, এ তো কখনও আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, তাও দু’চার দিন নয়, টানা ১৯ মাস। নিজের রাজ্যে নয়, জগন্নাথ-ধামে। কর্মজীবনের প্রান্তসীমায় এসে এমন একটি অপ্রত্যাশিত বজ্রাঘাত আমার সব কিছু ওলট-পালট করে দিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া টুকরোগুলোকে আবার এক জায়গায় করার না আছে সময়, না আছে এক ছটাক উৎসাহ। আমি এখন স্রেফ যেতে পারছি না বলে আছি, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব, বলার জায়গায় আর নেই।
ইন্দিরা গান্ধী একবার লিখেছিলেন, রাজনীতির শিক্ষানবীশদের প্রত্যেকের উচিত অন্তত একবার কিছুদিন কয়েদখানায় কাটিয়ে আসা। আমার সুপারিশ একটু অন্যরকম। মানুষকে কী ভাবে কুকুর-ছাগল বানিয়ে রাখা যায়, শুধু এইটুকু উপলব্ধি হওয়ার জন্য ভদ্দরলোকেদের উচিত কয়েদখানায় বেশ কিছুটা সময় কাটানো। কয়েদখানায় বসে জেফ্রি আর্চারের তিন খণ্ড ‘প্রিজন ডায়েরি’ পড়ার সময় বারেবারে একটি কথাই শুধু মনে হচ্ছিল। নরকে বসে যেন স্বর্গবাসের কাহিনি পড়ছি। বাপু উপদেশ দিয়েছিলেন, অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। এ দেশের কয়েদখানায় ঠিক তার উল্টোটা পালন করা হয় অক্ষরে অক্ষরে।
চারদিকে পাহাড় সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ভূখণ্ডটিতে ভালো-মন্দ মিশিয়ে কেটেছে আমার দিন। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিচিত্র ধরনের অপরাধীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাদের গপ্পো শুনেছি, অনেক দিন এক সঙ্গে থাকতে থাকতে কয়েক জনের সঙ্গে বেশ একাত্মতাও অনুভব করেছি। সারা জীবন ধরে রিপোর্টারি করার সুবাদে যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। মুশকিলে ফেলেছে বয়স আর অজস্র রোগ-ব্যাধি। বছর দশেক আগে হলে কয়েদখানার জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনায়াসে লিখতে পারতাম, বেদনা হল পরম রমণীয়। রমণীয়টা বলতে পারছি না, শুধুই যেন বেদনা।
বেঁচে থাকলে, আবার গুমঘরে চালান না হতে হলে কয়েদবাস নিয়ে দীর্ঘ লেখার বাসনা আছে আমার। আপাতত এই ‘গুমঘর গুলজার’-এ আমি সেই কয়টি ফিচার রেখেছি যা আমি গরাদের ওপার থেকে লিখেছিলাম, আমার স্ত্রী কস্তুরীর ফেসবুকের টাইম লাইনে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জেলে থাকতে থাকতেই আমার বেশ কয়েক জন অতি আপনজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম, তাদের স্মৃতি রোমন্থনও এখানে আছে। আছে জেলে পড়া কয়েকটি বই-এর আলোচনাও। এ সব মিলিয়ে জেলযাপনের সম্পূর্ণ ছবিটি নির্মিত হয় না অবশ্যই। তবে একটা অস্পষ্ট অবয়ব তো ফুটে ওঠে। আপাতত এইটুকুই থাক, বাকিটা তোলা থাক সময়, সুযোগের জন্য।
২০২০ সালের অগস্ট মাসে কলকাতায় ফেরার পরে এতগুলি মাস আমি কার্যত স্বেচ্ছা-গৃহবন্দির দিনই যাপন করেছি, এখনও করছি। একটা কারণ অবশ্যই কোভিডের ভয়, তার চেয়েও বড় কারণ চৌকাঠের ওপারে পা রাখতে অবশ নিষ্পৃহতা। চাকরি করি না, চাকরি চাইলেও কেউ দেবে না, বাইরে বেরিয়ে ঘোড়ার ডিম করবটা কী? কয়েদবাসের পর থেকে একটা অকারণ সঙ্কোচবোধও যেন আমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছে, পাছে লোকে কিছু ভাবে। হয়তো এটি এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আমি স্বচ্ছন্দ। ও আমার আঁধার ভালো।
অন্তরীণ হলে কী হবে, মস্তিষ্কটি এখনও সজাগ ও সক্রিয়, লেখার জন্য হাত-যুগল নিশপিশ করে। ভ্রাতৃসম এক বন্ধু নিজে উদ্যোগ নিয়ে আমাকে একটা ব্লগ-সাইট করে দিয়েছে, আমি তার নাম দিয়েছি বাংলাস্ফিয়ার। এটাই এখন আমার একমাত্র খেলাঘর।
গত কয়েক মাসে বিবিধ বিষয় নিয়ে বাংলাস্ফিয়ারে আমি অনেক লেখা লিখেছি, অতিথি লেখকদের দিয়ে লিখিয়েছি, দু’জন বন্ধু নানা বিষয়ে তর্জমাশ্রিত লেখাও লিখে দিয়েছেন। গুমঘর ছেড়ে এ সব নিয়েই আমার গুলজার।
আমার এই অবিশ্বাস্য সঙ্কটে যারা আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে প্রস্তরখণ্ডের মতো তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক ধন্যবাদ দেওয়ার নয়। স্ত্রী কস্তুরী, কন্যা টুপুর, পুত্র সায়র। সব ঘাটের জল খাওয়ার পরে যে সারসত্যটি বুঝেছি তা হল, আত্মজরাই শেষ পর্যন্ত পাশে থাকে। বাইরের কেউ কি থাকে না? হাতে গোনা কয়েক জন আছে অবশ্যই যাঁদের মধ্যে দু’জনকে আমি এই বই উৎসর্গ করেছি। সঙ্ঘমিত্রা ও দীপক রায়চৌধুরী।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

