logo

রাজধানীতে যখন বাঙালি আমলার স্বর্ণযুগ

  • August 13th, 2022
Books, Suman Nama

রাজধানীতে যখন বাঙালি আমলার স্বর্ণযুগ

রাজধানীতে যখন বাঙালি আমলার স্বর্ণযুগ

সুমন চট্টোপাধ্যায়

তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগটি কেটেছে সরকারি আমলাতন্ত্রের অলিন্দে, যেখানে প্রচারের আলো সে ভাবে পড়ে না, বস্তুত না পড়াটাই নিয়ম৷ ফলত আমলাদের অন্দরমহলের কাহিনি পারতপক্ষে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করে না, করার কথাও নয়৷ তাছাড়া সময়টাও এমন যার উপর কয়েক পোঁচ বিস্মৃতির পলেস্তরা পড়ে গিয়েছে জীবনের বহতা স্রোতের স্বাভাবিক নিয়মে৷ এই দু’টি প্রায় অনতিক্রম্য বাস্তব অসুবিধের মুখোমুখি হয়ে সাবলীল গদ্যে আগাগোড়া পাঠযোগ্য এবং একান্ত উপভোগ্য জীবনস্মৃতি লেখার ক্ষমতা সকলের আয়ত্তে থাকে না৷ অথচ ধ্রুব নারায়ণ ঘোষের কর্মজীবনের আলেখ্য ‘নো রিগ্রেটস’ সেই নিয়মে এক আশ্চর্য, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম৷ লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে কারও যদি পূর্ব-অভিজ্ঞতা কিংবা প্রবল উৎসাহ না-ও থেকে থাকে, তিনিও বইটি পড়ে নির্মল আনন্দ পাবেন অবশ্যই৷

ধ্রুব নারায়ণ এই দুর্লভ ক্ষমতা অর্জন করেছেন জ্ঞান-চর্চার বিবিধ ক্ষেত্রের সঙ্গে তাঁর আ-কৈশোর, অবিচ্ছিন্ন সখ্যের কারণে৷ জীবনস্মৃতিতে সেই অর্জিত পাণ্ডিত্য কিংবা পরিশীলিত রসবোধের উচ্চকিত বাহ্যাড়ম্ভর নেই কোথাও, জাহির করার সচেতন প্রয়াস তো নেই-ই৷ অথচ ইংরেজি সাহিত্য, সমাজচিন্তা কিংবা দর্শনে তাঁর অনায়াস বিচরণ হীরের স্নিগ্ধ বিচ্ছুরণ হয়ে আগাগোড়া ছড়িয়ে আছে লেখার পরতে পরতে৷ ছেলেবেলায় লেখাপড়ার প্রতি এমন অকৃত্রিম আগ্রহ ও উৎসাহের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন লেখকের মেজ-মামা, যিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই গ্রন্থ-কীট৷ সেই ঋণ-স্বীকার করেই ধ্রুব-নারায়ণ তাই মায়ের সঙ্গে এই মাতুলকে বইটি উৎসর্গ করেছেন৷

১৯৪৭ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় ধ্রুব নারায়ণের বয়স তখন ১৯৷ শিক্ষকের সন্তান, ছেলেবেলা কেটেছিল রাজা-শাসিত কোচবিহারে৷ প্রেসিডেন্সিতে অর্থনীতির স্নাতক, এমএ পরীক্ষাতেও সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে হয়তো তাঁর জীবন মোড় নিত অন্যদিকে৷ কে বলতে পারে বহির্বিশ্ব দাপিয়ে বেড়ানো আরও একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদের সন্ধান পেতাম আমরা! কিন্তু কমিউনিজমের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, স্টুডেন্টস ফেডারেশনে এলোমেলো সক্রিয়তা, বিপ্লবের আবছায়া স্বপ্নের ব্যাকুল মদিরতা, সে গুড়ে ঢেলে দিল বালি৷ এমতাবস্থায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানই যা করে থাকেন, বা করতে মজবুর হন, ধ্রুব নারায়ণ ঠিক সেই কাজটিই করলেন৷ তিনি বসে গেলেন আমলা হওয়ার জন্য সর্বভারতীয় প্রশাসনিক পরীক্ষায়৷ এবং কী আশ্চর্য, আইএএস না লিখে সেই পরীক্ষায় প্রথম পছন্দের চাকরি লিখলেন ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস৷ ইন্টারভিউয়ের সময় ইউপিএসসি-র তৎকালীন বঙ্গজ চেয়ারম্যান যখন যুবার এমতো বিস্ময়কর খামখেয়ালিপনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷

আর ঠিক সেই সময়টিতে, চাকরি গ্রহণের অব্যবহিত পরে ধ্রুব নারায়ণ যখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কিঞ্চিৎ কাতর, প্রিয় ভাগিনেয়কে একটি দীর্ঘ চিঠিতে জীবন-চর্চার সারমর্মটি তাঁর মতো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মেজ-মামা৷ তিনি লিখেছিলেন, ‘চাকরিতে থাকাকালীন চেষ্টা করবে একই সঙ্গে দু’টি মনকে গড়ে তুলতে৷ একটি মন থাকবে কাজে, তার লক্ষ্য হবে ঊর্ধ্বতনের সন্তুষ্টি বিধান করা, অধঃস্তনদের প্রতি ন্যায়-বিচার এবং নিরলস পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে কর্তব্য-সাধন৷ অন্য মনটি নিয়ে ডুব দেবে ‘কায়েন মনসা বাক্যে’, তাকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে৷ জীবনের অর্থ বা সার খুঁজে পাওয়াটাই ‘আনন্দ’৷ আমার মতে, জ্ঞানার্জনের পথে পদ-চারণা করেই সেই আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব৷ নিজের ওপর বিশ্বাস হারাবে না, দেখবে, তোমার চাকরিই তোমাকে এই পথে এগোতে সাহায্য করবে৷’

এর পরেই একটি মজার মন্ত্র শুনিয়েছিলেন তিনি৷ ‘জ্ঞান-চর্চা করবে গোপনে, কাউকে তার আন্দাজ পেতে দেবে না৷ সেটাই হবে তোমার গোপন সম্পদ৷ বললে কেবল তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের বলতে পার, অন্য কাউকে কদাপি নয়৷’ জীবন-স্মৃতির একেবারে শেষে এসে ধ্রুব নারায়ণ লিখছেন, আজ যদি আমার নাতনি আমার কাছে জানতে চায়, তার জীবনের ‘টালিসমান’টি কী হওয়া উচিত, আমি তাকে মেজো মামার লেখা এই চিঠিটিই ভালো করে পড়ে দেখতে বলব৷ সারা-জীবন ধরে মামার এই উপদেশকে ধ্রুব-তারা জ্ঞানে অনুসরণ করেছেন ধ্রুব নারায়ণ, নিজস্ব মূল্যবোধকে আঁকড়ে থেকে অ-পছন্দের পেশাকেও সহজ মনে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি৷ এমনকী কর্মজীবনের উপান্তে লার্সেন অ্যান্ড ট্যুব্রোর চেয়ারম্যান থাকাকালীন প্রবল পরাক্রমশালী আম্বানি গোষ্ঠীর ক্রমাগত চাপের কাছেও নয়৷

অতএব ‘নো রিগ্রেটস’৷ আক্ষেপ নয়, অনুশোচনা নয়, কেবলই আনন্দ৷

এক মধ্য-রাতের কড়া নাড়া দিয়ে শুরু এই স্মৃতি-কথা৷ ১৯৬৯ সালের ১৭ জুলাই৷ বিছানায় শুয়ে তন্দ্রাদেবীর শরণাপন্ন হওয়ার চেষ্টা করছেন, বেজে উঠল ধ্রুব নারায়ণের টোলিফোন৷ ওপারে পরমেশ্বর নারায়ণ হাকসার৷ বার্তাটি গম্ভীর এবং যারপরনাই সংক্ষিপ্ত৷ ‘বিছানা ছেড়ে উঠে এখনই চলে এস আমার বাড়িতে৷’ নিজেই ড্রাইভ করে দিল্লির সেই নিশুতি রাতে যাওয়ার সময় ধ্রুব নারায়ণ বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন এমন অসময়ের অপ্রত্যাশিত তলবের গূঢ় কারণটি৷ তার মানে বোধহয় এ বার সত্যিই ব্যাঙ্কের জাতীয়-করণ হতে চলেছে৷ কেননা তার কিছুদিন আগেই এআইসিসি-র এক অধিবেশনে এই মর্মে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷

ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের গতিতে তখন জাতীয়করণের অর্ডিন্যান্সটি পাশ হয়েছিল এবং তার পরে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল আইনি কুরুক্ষেত্র৷ তখন কেন্দ্রীয় সরকারের ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সামান্য ডেপুটি সেক্রেটারির পদে থাকলেও ব্যাঙ্কিং আইন নিয়ে পারদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা থাকার কারণে চরম গোপনীয় এই রুদ্ধশ্বাস নাটকে ধ্রুব নারায়ণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ লেখক জীবনস্মৃতির শুরুতেই কয়েকটি পরিচ্ছেদে সেই নাটকের বিবিধ দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন প্রায় ক্রাইম-থ্রিলার লেখকের মুন্সিয়ানা নিয়েই৷ পড়তে পড়তে তাই মনে হতে থাকে চোখের সামনে যেন ফের জীবন্ত হয়ে উঠছে ইন্দিরা, মোরারজি-সহ সেদিনের সেই দিকপাল কুশীলবেরা৷ কংগ্রেস দলে তো বটেই, আমলাতন্ত্রেও৷

১৭ জুলাই মধ্যরাতের সেই ঘুম ভাঙানো টেলিফোন থেকে ১৯ জুলাই মধ্যরাত্রির মধ্যে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল প্রথমে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত এবং তার পরে অর্ডিন্যান্স তৈরির কাজ৷ পি এন হাকসার এমন একজন জুনিয়র অফিসারের ওপর কেন নির্ভর করছেন, চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ঘুচিয়ে তা পরখ করে দেখে নিতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা স্বয়ং৷ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই জরুরি বৈঠকে ধ্রুব নারায়ণের পালস রেট চকিতে এতই বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি টেবিলের ওপর রাখা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন৷ অর্ডিন্যান্স তৈরিতে এমন প্রথা-বিরুদ্ধ গোপনীয়তা কেন, সে প্রসঙ্গে একটি কারণ লেখককে জানিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই৷ ২০ জুলাই উপরাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভি ভি গিরি তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেবেন৷ অতএব অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে (জাকির হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুর পরে) তাঁর স্বাক্ষরটি সংগ্রহ করতে হবে ১৯ তারিখ মধ্যরাত্রির মধ্যেই৷ হাকসারের নির্দেশে গিরির স্বাক্ষর আনতে সে রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে হয়েছিল এই জুনিয়ার ডেপুটি সেক্রেটারিটিকেই৷

গোপনীয়তার দ্বিতীয় কারণটি পরে বুঝতে পেরেছিলেন ধ্রুব নারায়ণ৷ ইন্দিরা কিছুতেই চাইছিলেন না, সরকারের এই উদ্যোগের খবর মোরারজি দেশাইয়ের কর্ণগোচর হোক৷ তার অব্যবহিত আগে মোরারজি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ করেছেন এবং প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর মন্ত্রিসভাতেই থাকতে চান না৷ ইন্দিরার দুর্ভাবনা ছিল ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হচ্ছে জানতে পারলে মোরারজি আর ইস্তফা দেবেন না, বরং নেপো হয়ে দই মারার মতো এমন একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কৃতিত্ব তাঁরই বলে জাহির করা শুরু করবেন৷ বিশেষ করে এই কারণে যে তার আগে ব্যাঙ্কগুলিকে ‘সোশ্যাল কন্ট্রোল’-এর আওতায় নিয়ে আসার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, মোরারজিই ছিলেন তার প্রধান কান্ডারি৷ সে সময় ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সচিব আই জি প্যাটেল ছিলেন মোরারজির কাছের লোক৷ অতএব অর্ডিন্যান্স তৈরির কথা তাঁরও আগে জানতে পারেন ধ্রুব নারায়ণ আর আই জি জানতে পারেন মোরারজির ইস্তফা গৃহীত হওয়ার পরে৷

এই পর্বের উপাখ্যান পড়তে পড়তে দু’টি জিনিস নজর কাড়ে অবধারিত ভাবে৷ প্রথমত, দিল্লির সর্বোচ্চ ক্ষমতার অলিন্দে এতজন বঙ্গসন্তানের দাপাদাপি৷ বিদেশ সচিব সুকোমল দত্ত সবে অবসর নিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অন্যতম সচিব সুশীতল বন্দ্যেপাধ্যায়৷ যে তিন জন অফিসার মিলে দিন-রাত এক করে অর্ডিন্যান্সের খসড়া তৈরি করলেন তাঁদের মধ্যে দু’জনই বাঙালি— ধ্রুব নারায়ণ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর এস কে মৈত্র৷ হাকসারের নিকট বন্ধু হিসেবে যে ভদ্রলোক তখন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, আইএফসিআই-এর তৎকালীন সেই চেয়ারম্যানও বঙ্গসন্তান-এ বক্সি৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ননী পালকিওয়ালার মতো যশস্বী আইনজীবীর বিরোধিতা সামলে যিনি সরকারকে জয়ী করে এনেছিলেন তিনি নীরেন দে, ঘোষিত বামপন্থী হওয়া সত্ত্বেও যাঁকে কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল করেছিলেন৷ এমনকী মৈথিলি ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর এল কে ঝা-ও বাংলায় ছিলেন সড়গড়৷ দিল্লিতে তখন সফল বাঙালি আমলাদের সুবর্ণযুগ, কালে কালে যা ফল্গুধারার মতো অকিঞ্চিৎকর হয়ে গিয়েছে৷ দ্বিতীয়ত, ধ্রুব নারায়ণের এই কাহিনির তাৎপর্যও ঐতিহাসিক কেননা সরকারি কোনও নথিতে অথবা দলিলে জাতীয়করণের উদ্যোগের এমন নাটকীয় প্রেক্ষাপট এত বিশদে বলা থাকবে না৷ হয়তো সে জন্যই স্মৃতিকথার মুখবন্ধে সবিনয়ে লেখক বলেছেন, ‘অল দিস অ্যান্ড মেনি আদার এপিসোডস উড রিভিল সামথিং দ্যাট দ্য অফিশিয়াল আর্কাইভস অব দ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া আর সায়লেন্ট অন৷’

ধ্রুব নারায়ণ নিজে ছিলেন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সমর্থক, ঘটনার ৪৫ বছর পরেও সেই অভিমত থেকে তিনি একচুলও সরে আসেননি৷ এ কথা জেনেও যে এমনতরো অভিমত পোষণের জন্য বর্তমান প্রজন্ম তাঁর দিকে সংশয়াবিষ্ট চোখে তাকাতে পারে৷ ভাবতে পারে অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো নমনীয়তাও ভদ্রলোকের নেই৷ লেখক মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন প্রশ্নটা তখন ভালো না মন্দ এই দু’য়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না৷ তার চেয়েও বড় কথা যেটা ছিল তা হল ‘সোশ্যাল কন্ট্রোল’ প্রক্রিয়া চালু হয়ে যাওয়ার পরে পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছিল তাতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ছিল প্রায় অবশ্যম্ভাবী৷ আজ না হয় কাল৷ ইন্দিরা গান্ধী এ কাজ না করলে সে সময় অন্য কেউ তা করে দিতেন অবশ্যই৷ ফলে এই সিদ্ধান্তে এক ধরনের অনিবার্যতা ছিলই৷

ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর তখন সদ্য তৈরি হওয়া ব্যাঙ্কিং দপ্তরে কাজ করেছিলেন ধ্রুব নারায়ণ৷ সরকারি নিয়ন্ত্রণে এলেও দলীয় রাজনীতি এবং তজ্জনিত দাক্ষিণ্য বণ্টনের অশুভ ছায়া থেকে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে সময় ভারপ্রাপ্ত আমলারা কতটা যত্নবান এবং আন্তরিক ছিলেন, কী ভাবে ব্যাঙ্কের ব্যবসায়িক স্বার্থকে সব কিছুর ওপর স্থান দেওয়া হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে বইটিতে৷ এই বিবরণের মধ্যে দিয়ে ধ্রুব নারায়ণ সম্ভবত এই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যাঙ্কের ব্যবসা সফল ভাবে চালানো সম্ভব৷ সমস্যার উৎপত্তি হতে শুরু করে তখনই যখন ‘লেসার মর্টাল’-দের হাতে চলে আসে পরম্পরা রক্ষার গুরু দায়িত্ব৷ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এদেশে সেটাই হয়েছে৷

সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে ধ্রুব নারায়ণ চার বছর স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ অবসরের পরে টানা বেশ কয়েক বছর তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল কর্পোরেট দুনিয়া, কর্ণধার ছিলেন যথাক্রমে ফিলিপস ইন্ডিয়া, লার্সেন অ্যান্ড ট্যুবরো, সেঞ্চুরিয়ন ব্যাঙ্ক, পিয়ারলেস এবং রেটিং সংস্থা ইকরার৷ পিয়ারলেসের দায়িত্ব তিনি অস্বীকার করতে পারেননি একমাত্র জ্যোতি বসু তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন বলে৷ প্রয়াত এই কমিউনিস্ট নেতা সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের কথা গোপন করেননি ধ্রুব নারায়ণ৷ ঠিক যেমন সত্যের খাতিরে এ কথা জানাতেও ভুল করেননি যে সেই জ্যোতিবাবুই একদা তাঁকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়ে আম্বানিদের হয়ে তাঁর কাছে ওকালতি করেছিলেন৷

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *