- August 12th, 2022
 
গরিলার হুঙ্কার
নিরানন্দর জার্নাল (৪)
গরিলার হুঙ্কার
সুমন চট্টোপাধ্যায়
উপরের ছবিটি মন দিয়ে দেখুন। বাকিটা চিনা ভাষায় লেখা, মর্মোদ্ধার করা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। ছবিটা নয়।
পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয়েছে দু’টি ছবি, প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে একটা চিনা রকেট অগ্নি-সংযোগের পরে উৎক্ষেপনের প্রতীক্ষায়। পাশে ভারতের কোনও একটি শ্মশান, কোভিডে মৃতের চিতার লেলিহান আগুন। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা, ‘Chinese ignition versus Indian ignition.’
চিনা সরকার নিয়ন্ত্রিত জনপ্রিয় ওয়েবসাইট Weibo-তে খুব সম্প্রতি এটি পোস্ট করা হয়েছিল যা চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ মহলের স্পষ্ট সবুজ সঙ্কেত ছাড়া অসম্ভব। কেন না এই ওয়েরসাইটটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা কমিশন।
হাতি যখন পাঁকে পড়ে, চামচিকেতেও লাথি মারে, এই প্রচলিত প্রবাদটি এখানে যুৎসই হবে না। এক্ষেত্রে লাথিটা যে মারছে সে নিজেই মহা-হস্তী। ভারত যে চামচিকের ঊর্ধ্বে কিছু নয়, এই রকম একটি কুরুচিকর উদ্যোগের অঘোষিত উদ্দেশ্য সেটাই প্রকারন্তরে প্রমাণ করা।
চিনা নেটিজেনরা প্রতিবাদ করায় ওয়েবসাইটটি ছবিটা তুলে নিয়েছে, যদিও কাজটির যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক বন্ধ হয়নি। চিনের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক দ্য গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু শিনজিনের মনে হয়েছে এর ফলে ভারতের কাছে চিনের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাংহাইয়ের এক উগ্র চিনা-জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক শেন ইয়ে নিজের অন-লাইন পোস্টে তুলোধনা করেছেন সমালোচকদের। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘ভারতের প্রতি লোক দেখানো সহানুভূতি প্রদর্শন করলেই কি প্রার্থিত ফল পাওয়া যেত? রাজনৈতিক ভাবে একটু-আধটু পেশি-প্রদর্শন আমাদের করতেই হবে। আটশো পাউন্ড ওজনের একটা গরিলা শোবে কোথায়? স্পষ্ট উত্তর হল, যেখানে ইচ্ছে সেখানেই।’
চিনকে একটু আগেই আমি মহা-হস্তী বলেছি, সেটা প্রত্যাহার করে নিয়ে এ বার থেকে বলব ৮০০ পাউন্ডের গরিলা যার যা ইচ্ছে সেটাই করার অধিকার আছে। বেশ কিছুকাল হল ভারতের সঙ্গে চিন ক্রমাগত এই দাদাগিরিটাই করে চলেছে, কখনও ডোকলামে কখনও লে কখনও অরুণাচল প্রদেশে। তাই বলে প্রতিবেশীর ঘোর বিপন্নতা নিয়ে এমন কদর্য রসিকতা? ধ্যাষ্টামোরও তো একটা সীমা থাকা উচিত।
আমেরিকাকে সরিয়ে চিন এখন বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার স্বপ্নে মশগুল। অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে চিন, দেশটার প্রায় অলৌকিক উন্নতি হয়েছে, এই স্বপ্নটি সাকার হওয়ার সম্ভাবনাও অতীব উজ্জ্বল। ভারতের প্রতি ড্রাগনের বিদ্বেষের অন্যতম কারণ বেজিং মনে করে নয়াদিল্লি ইদানীং তাদের শত্রু-শিবিরের মিত্র-শক্তি হয়ে উঠেছে, তাই মাঝে মাঝে একটু কানমলা দেওয়া প্রয়োজন। চিনা আগ্রাসনের মুখে আমরা কতটা অসহায় সম্প্রতি তার প্রমাণ আমরা বারেবারে পেয়েছি, সেই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গে নাই বা ঢুকলাম।
কথায় কথায় চিনের এই যে দাদাগিরি, কূটনীতির পণ্ডিতেরা তার নাম দিয়েছেন ‘wolf war diplomacy’ যার সারকথা হল, যে কোনও বিষয়ে চিনের সমালোচনা করা হলে গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ ভাবে তার প্রতিবাদ করবে, বেজিংয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা করবেন, চামচা-মিডিয়া করবে, দেশে দেশে চিনা দূতাবাসগুলোও করবে। শিনজিয়ান প্রদেশে উইঘুর দমন কিংবা হংকংয়ে গণতন্ত্রের আন্দোলনের টুঁটি চিপে ধরা নিয়ে সরব আন্তর্জাতিক সমালোচনার জবাব ঠিক এ ভাবেই দিয়েছে চিন, এখনও দিচ্ছে। যূথবদ্ধ নেকড়ের পালের মতো। শি জিন পিংয়ের চিন আঘাতের জবাব প্রত্যাঘাতে দেওয়ায় বিশ্বাস করে, ঢিল মারলেই পাটকেল।
সৌজন্য অথবা রুচির তোয়াক্কা না করে চিনা-জনতার সামনে ভারতকে খাটো করে দেখানোর আরও একটা গুরুতর মতলব আছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা নড়বড়ে, মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে এই ব্যবস্থা কতটা অক্ষম এই চিত্রটি তুলে ধরে নিজেদের একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা। অনেকটা যেন গণতন্ত্রপ্রেমী চিনাদের বারেবারে মনে করিয়ে দেওয়া চিনা ব্যবস্থাটিই শ্রেষ্ঠ।
আমি চিনে গিয়েছি অনেকবার। চিন নিয়ে আমার একটি বইও আছে, নাম ‘চিনে বসন্ত’। যতবার গিয়েছি মনে হয়েছে আরে এ তো নতুন দেশ। এমন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আর সামরিক শৃঙ্খলায় দুনিয়ার কোনও দেশ কখনও উন্নতি করতে পারেনি, সবটাই একেবারে স্বপ্ন দেখার মতো। নিজের মনে অনেক সময় ভেবেছি, এতৎসত্ত্বেও আমার সামনে যদি চিনা নাগরিক হওয়ার সুযোগ আসে আমি তা গ্রহণ করব কি? উত্তরটিও পেয়ে গিয়েছি সঙ্গে সঙ্গেই। না, কিছুতেই নয়। এই যে আমার হাতের আঙুলে এখনও ভোটের কালির দাগ লেগে আছে এর মর্ম অথবা গুরুত্ব চিনারা কখনওই বুঝবে না, বোঝার সুযোগই পাবে না। তাই ‘আমার আঁধার ভালো/ আলোকে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে/ ও আমার আঁধার ভালো।’

	
							
Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

