- August 17th, 2022
বুদ্ধং শরণং (পর্ব-৪)
সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘ভুল যখন করেছো, তখন সেটা প্রকাশ্যে স্বীকার করো।’ বক্তার নাম জ্যোতি বসু। উপদেশ দিচ্ছেন যাঁকে, তাঁর নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্য বামফ্রন্টের জরুরি বৈঠকে। সংখ্যালঘু বিক্ষোভে রাজ্য তখন উত্তাল, হঠাৎই স্বখাত সলিলে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০০২-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা।
মুখ্যমন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিলেও তার পরে বহুদিন নিয়মিত আলিমুদ্দিনে পার্টি অফিসে যাতায়াত করতেন জ্যোতিবাবু। রাজ্য কমিটি, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী কিংবা বামফ্রন্টের বৈঠক থাকলে তো বটেই। আর এই আলোচ্য বৈঠকটি ডাকা হয়েছিল আপৎকালীন পরিস্থিতিতে, অভিজ্ঞ জ্যোতি বসুর উপস্থিতি ছিল একান্ত আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রীকে মুখের ওপর ভর্ৎসনা করার লোক আর কোথায়?
অশান্তির সূত্রপাত রাজ্যের সীমান্ত এলাকার খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিয়ে বুদ্ধবাবুর বিরূপ মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। সে বছর ১৯ জানুয়ারি শিলিগুড়িতে সিপিএমের জেলা সম্মেলনের মঞ্চ থেকে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘যে সব মাদ্রাসাগুলি থেকে আইএসআই ও তাদের এজেন্টরা ক্রিয়াকলাপ চালাচ্ছে সেগুলি রাজ্য মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদিত নয়। তাদের চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ ২৩ জানুয়ারি দিল্লির একটি পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী আইএসআই-য়ের সঙ্গে এই সব খারিজি মাদ্রাসার সম্পর্ক বিশদে ব্যাখ্যা করেন। ঠিক তার পরের দিন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায় কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে যে দেশ বিরোধী প্রচার হচ্ছে রাজ্য সরকারের হাতে তার তথ্য প্রমাণ আছে। রাজ্যের সব ক’টি সংবাদপত্র ফলাও করে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছাপে, এমনকী দলীয় মুখপত্র গণশক্তিও। এর মাঝে ২২ জানুয়ারি কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে সশস্ত্র জঙ্গিহানায় কয়েক জন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ধরা পড়ে সন্ত্রাসীদের পাক-যোগাযোগ।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়া নন, যিনি সচেতন ভাবে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেবেন, সততার মতো তাঁর ধর্ম-নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও কোনও প্রশ্ন তোলা মূর্খামি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে অবশ্যই তাঁর হাতে কিছু উদ্বেগজনক তথ্য এসে থাকবে যার ভিত্তিতে তিনি এই সব মন্তব্য করেছিলেন। বুদ্ধবাবু বিষয়টিকে দেখেছিলেন প্রশাসকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যে সারসত্যটি তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা হল, প্রশাসন আর রাজনীতির মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব লাগে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কারণে রাজনৈতিক স্বার্থ আহত হয়, তাহলে প্রশাসক সত্ত্বাটিকে আড়াল করে ফেলতেই হবে। মেনে চলতেই হবে যস্মিন দেশে যদাচারের পথ।
স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যে গোটা মুসলিম সমাজ উত্তাল হয়ে উঠল, বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন নেমে পড়ল রাজপথে। জামাত-এ-উলেমা হিন্দের উদ্যোগে ময়দান চত্বরে এত বড় প্রতিবাদ সভা হল সাম্প্রতিককালে যার সমতুল কোনও নজির নেই। ওই সমাবেশ থেকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হল, মাদ্রাসা নিয়ে যা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী যদি তা অবিলম্বে প্রত্যাহার না করেন তাহলে রাজ্য জুড়ে আরও জোরদার আন্দোলন শুরু হবে। ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়লেন বিরোধী নেতারাও। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানালেন। রাজ্যের কয়েকটি সীমান্ত এলাকা ঢুঁ মেরে এসে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি দাবি করলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় রাজ্য সরকার যথেষ্ট প্রাথমিক স্কুল তৈরি করতে পারেনি বলেই হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারের বাচ্চারা খারিজি মাদ্রাসায় পড়তে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোথাও কোনও মাদ্রাসায় দেশ বিরোধী ক্রিয়াকলাপ হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজাসুজি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে মুসলিম বিরোধী বলে দেগে দিলেন। বামফ্রন্টের অন্দরে শরিকি বিক্ষোভ রোজ একটু একটু করে বাড়তে থাকল। চক্রব্যূহের মাঝখানে দাঁড়ানো অভিমন্যুর মতো দশা হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের।
এমনই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি ডাকা হল বামফ্রন্টের আপৎকালীন বৈঠক, মুখ্যমন্ত্রীকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শরিক দলের নেতারা সব চোখা চোখা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। এমনকী বিমান বসু, অনিল বিশ্বাসও মন্তব্য করলেন, এই সমস্যাকে গোড়াতেই থামিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, এত দূর জল গড়াতে দেওয়াই ঠিক হয়নি। সমাধানের দিশা বাতলে দিয়ে জ্যোতিবাবু বললেন, ভুলের জন্য একবার প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
এমনিতেই ছড়িয়ে বসে আছেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আরও ছড়িয়ে ফেললেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আর পাঁচজন পাতি রাজনীতিক সঙ্কটে পড়লে যা করে থাকেন বুদ্ধবাবু হাঁটলেন সেই রাস্তাতেই। তিনি বললেন, মিডিয়া নাকি তাঁর বক্তব্য বিকৃত করে ছেপেছে, এমনকী তাঁর নিজের দলের মুখপত্রও। বৈঠকের শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার সাহসটুকুও বুদ্ধবাবু দেখাতে পারলেন না, বিমান বসুর কাঁধে চাপল সেই অস্বস্তিকর দায়িত্ব। মায়া নয়, আমার সেদিন রীতিমতো রাগই হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওপর।
দলের ভোট বিপন্ন হয় এমন কোনও কাজ করলে দল যে পাশে দাঁড়াবে না এই ঘটনা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সেই উচিত শিক্ষাটি হয়েছিল কী? বলা কঠিন। বুদ্ধবাবু যখন বারে বারে পাকিস্তান আর আই এস আইয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন, সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তখন কী করছিলেন? কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি যে প্রেস বিবৃতিটি জারি করেছিল তার বয়ান ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের ঠিক উল্টো। আর ঠিক সেই সময়ই দলের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎ পিপলস ডেমোক্রাসিতে এক ঢাউস নিবন্ধ লিখলেন পাকিস্তানের ফৌজি প্রশাসক মোশারফের ভূয়সী প্রশংসা করে। দিন গেলে সিপিএমের ভোটারদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যে বিজেপি-র দিকে ঢলে পড়েছে, এই ঘটনায় তার উৎস সন্ধান করা যায় কি?
বুদ্ধবাবুর ‘বুকের পাটা’ দেখে একজন অবশ্যই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কেন না সিপিএমের কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের লব্জে প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলতে পারেন, এটা তাঁর কল্পনার অতীত ছিল। আমেরিকান সেন্টারের সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে তৎপর করে তুলেছিলেন তিনি। বলুন তো তাঁর নাম কী?
সঠিক অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার দেওয়া যাবে না, উত্তর এতটাই সহজ। লালকৃষ্ণ আদবানি। (চলবে)


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

